অভিমত
মন্দিরে হামলা কি চলতেই থাকবে?
মরমি কবি মহাত্মা লালন ফকির বলতেন, ‘কপালের নাম গোয়ে গোবরে, সবই কপালে করে।’ কিন্তু কবির জমানা শেষ। এখন এই দেশে সংখ্যাগুরুরা নিজ হাতে কপাল বিনির্মাণ করে। আর দুর্ভাগ্যের প্রবচন হিসেবে প্রচলন করে দেয়, ‘হিন্দুর কপাল’। এতদাঞ্চলে দ্বিজাতি তত্ত্বের চরম সাম্প্রদায়িকতা থেকে উদ্ভূত দেশভাগের পর থেকেই হিন্দুদের পোড়া কপালের বীজ বপন চলে আসছে। সেই বীজ আজ মহীরূহে রূপান্তরিত। এখন চুন থেকে পান খসলেই হিন্দুকে গলাধাক্কা দেওয়া যায়, বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া যায়, ধর্ষণে ডুবিয়ে দেওয়া যায় পুরো মানবতা। তারপর অত্যাচারে জর্জরিত হিন্দুর ছেড়ে যাওয়া অর্পিত সম্পত্তি জবরদখল করে ভোগবিলাসে মত্ত হওয়া যায়।
এবার বলি করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজ নামের একজনকে। যাকে হাজির করা হয়েছে পবিত্র কাবা শরিফের অবমাননাকারী হিসেবে। ফেসবুকে ধর্মাবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন -অন্য কেউ তার ফেসবুকে ঢুকে ওই স্ট্যাটাস দিয়েছে। এরপর প্রশাসনের খতিয়ে দেখা উচিত ছিল, কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাম্প্রদায়িক বিরোধ উসকে দিতে চাইছে কি না? কিন্তু তা না করে স্থানীয় সুবিধাবাদী উগ্রবাদী গোষ্ঠী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের একটি সংগঠনকে বিক্ষোভ সমাবেশ করার অনুমতি দেয় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি, ওই সমাবেশ থেকে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। তাহলে আমরা কি বলতে পারি, ধর্মের ‘অনুভূতি বিনষ্ট’ হলে প্রতিহিংসা ও জিঘাংসা চরিতার্থ করে হিন্দুর বাড়িতে লুটপাট বা চুরিচামারি করলে ‘অনুভূতি’রা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে?
একই ধারার নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল রামুর বৌদ্ধপল্লীতেও। প্রতিটি ঘটনাতেই গায়ের জোরে অমুসলিম একজন ব্যক্তিকে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করে পুরো গোষ্ঠীকে ভুক্তভোগী করা হয়। বরাবর স্থানীয় প্রশাসন এসব ঘটনা সামাল দিতে ব্যর্থ হয় এবং ভেঙ্গে দেওয়া হয় হিন্দু, বৌদ্ধ বা পাহাড়ি আদিবাসীর মনোবল। হাজার বছর ধরে চলে আসা নিজের ঐতিহ্যবাহী ধর্মকে এত নিচে নামিয়ে আনা হয় যে, একটা ছবি বা দু-চারটে কথায় সেই শক্তপোক্ত ধর্মের স্তম্ভরা ঝরঝর করে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু মানুষের ধর্মাচার কি এত ঠুনকো?
আজ যারা মার্কিন জাকারবার্গের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে ধর্মানুভূতির রক্ষা বা বিনষ্টির সূতিকাগার মানছেন সেসব মাওলানারা নিজেদের ধার্মিক বলে পরিচয় দেন। কিন্তু ধর্মের আদি, আসল ও নিগুঢ় তত্ত্বে তাঁদের কোনো আস্থা নেই। অথবা সেই আস্থাটা রাখলে হয়তো হিন্দুর ভূমি দখলের মাধ্যমে নিজেদের বিত্তবৈভব বা শানশওকতটা আর বাড়ানো যায় না। হিজরি প্রথম সালে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ সাম্যবাদী মহানবী প্রণীত ইসলামের প্রাথমিক সংবিধান ‘সাহিফাত আল মাদিনাহ’ বা মদিনা সনদ আর বিশ্বাস করেন না কোনো উগ্রবাদী। উগ্রবাদীদের আসল কাজ এখন উদরপূর্তি। সেই উদরপূর্তির বাণিজ্যের অনুষঙ্গ হলো তাদের স্বেচ্ছাচারী ধর্ম। মহানবীর ধর্ম নয়!
আমাদের মহানবী মদিনা সনদে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, কোনো লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে, তার জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে। অসহায় ও দুর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে এবং সব ধরনের রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে।
এখন বলা হোক, বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলমান মদিনা সনদের এসব কোনো ধারা মেনে চলছেন? এখানে কথায় কথায় দুর্বলকে আঘাত করা হচ্ছে। খুন-ধর্ষণে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে মানবতা। এমনকি শিশুদেরও রেহাই মিলছে না! বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে মানবীয় বোধ। রসরাজ যদি অপরাধ করে থাকে তার বিচার দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী হবে। ধর্মের কোথায় লেখা আছে যে, সেই অপরাধীর গোষ্ঠীকে দেশ ছাড়া করে দিতে হবে?
সরকারে থাকা সেক্যুলার নামধারী দলও এখন ওলামালীগ পোষে; যেখানে দেদারসে ঢুকে পড়ছে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী মৌলবাদীরা। যে ধর্মান্ধ মোল্লারা সামান্য ইস্যু পেলেই ফায়দা লুটবার নিপুণ কারিগর সেজে বসে। এখন সেই সরকার কি অন্যায়-অত্যাচার শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাবে? তাদের ভোটের রাজনীতি কি তবে সমাপ্ত? তাদের মুখে কেন এই ব্যাপারে রাও ফোটে না? হিন্দু নিপীড়নের সুবিধাভোগী তবে কারা? এইসব প্রশ্ন জোড়ালভাবে উঠবার আগে অবিলম্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দু কমিউনিটিতে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সেখানকার নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ অসহায় মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা দাবি করছি।
সদ্যই বিশ্ব অ্যাম্বাসেডর ইংলিশ ক্রিকেটার অ্যালিস্টার কুকরা বলে গেলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা আহামরি রকমের ভালো। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলে গেলেন, এই দেশের উন্নয়নের গতি বিস্ময়কর! তো আমরা এখন এই নিরাপত্তা আর ৭ এর উপর জিডিপি এবং দেশের গর্ব পদ্মা সেতু ধুয়ে কি পানি খাব, যদি এখানকার মানুষের সম্প্রীতি, সৌহার্দ, প্রেম আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারি?
মানবতা বিধ্বংসী নামধারী উগ্র মুসলমানরা যে পাপে দিনের পর দিন নিজেদেরকে ডুবিয়ে যাচ্ছে, সহসা সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করা গেলে আমাদের অনন্ত নিমজ্জন কেউ ঠেকাতে পারবে না! যারা মনে করেন, এই ভূমি শুধুই মুসলমানের, হিন্দুর জায়গা এটা না, এমন বিকৃত চেতনাধারী ও নোংরা মানসিকতায় দুষ্টদেরকে নিন্দা জানাই।
কবে হবে এই ভূমি কেবলই মানুষের? কতিপয় হীন মৌলবাদীর জন্য মুসলমান হিসেবে চরম লজ্জাবোধ করি! খুব লজ্জিত আমরা!
তাই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মগজ ও মননে রেখে উদারতা ও ভালোবাসাকে সবার আগে স্থান দিন। আর অনুভব করুন পৃথিবী সত্যি সুন্দর। কণ্ঠে ঝরুক সাম্যের গান। দেখবেন মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন