সমবায় দিবস
জাতীয় সমবায় দিবস : একতাই বল
‘সমবায়ের দর্শন টেকসই উন্নয়ন’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে প্রতিবারের মতো এবারেও সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় সমবায় দিবস। সমবায়ের একটি বিশ্বজনীন চরিত্রও রয়েছে। কারণ ১৯২৩ সাল থেকেই জুলাই মাসের প্রথম শনিবারকে আন্তর্জাতিক সমবায় দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে। তারপর ১৯৯৫ সাল থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মোতাবেক তা ওই দিন বিশ্ব সমবায় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর পরই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে জাতীয়ভাবে এ দিবস পালিত হয়ে আসছে।
এ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ৪৫তম জাতীয় সমবায় দিবস পালন করা হচ্ছে। গত বছর ৪৪তম জাতীয় সমবায় দিবসটি নভেম্বর মাসের প্রথম শনিবার হিসেবে ৭ নভেম্বর পালিত হয়েছিল। আর এবারে দিবসটি নভেম্বর মাসের প্রথম শনিবার হিসেবে ৫ নভেম্বর তারিখে পালন করা হচ্ছে। সমবায় আন্দোলনটি ১৯০৪ সালে কৃষকদের সংগঠিত করার মানসে শুরু হলেও বর্তমানে তা কৃষি, মৎস্য, দুগ্ধ, গৃহ ও দারিদ্র্য বিমোচনের সাথেই বেশি সংশ্লিষ্ট। সমবায় কথাটির সাথেই সমতা, একতাবোধ, সমন্বয়, সামষ্টিক ইত্যাদি কিছু ধারণা সামনে চলে আসছে। কবিতা কিংবা জনপ্রিয় কিছু স্লোগান বা শ্লোক, প্রবাদ-প্রবচন রয়েছে সমবায়ের থিমকে উপলব্ধিতে নিয়ে, যেমন- ‘দশে মিলে করি কাজ হারি-জিতি নাহি লাজ’, ‘একতাই বল’, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে প্রতিবছর বাংলাদেশে দিবসটি খুব গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়ে থাকে। দিবসটি পালন উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বাণী দিয়ে থাকেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। গণমাধমেও দিবসটিকে নিয়ে থাকে বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয়ভাবে ঢাকায়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সমবায়ীদের নিয়ে সমবায়ের মাধমে সুষম উন্নয়ন, সঞ্চয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে দিবসের স্লোগান সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন, প্লেকার্ড ইত্যাদি নিয়ে র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে সফল সমবায়ীদের উৎসাহ প্রদানের জন্য পুরস্কৃত করা হয়।
সমবায়ের মূল প্রবক্তা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি পূর্ববঙ্গে তাঁর জমিদারিকালে কৃষি সমবায়ের উদ্দেশ্যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে তেভাগা দাবিতে নাচোলের ‘রানী মা’ খ্যাত ইলা মিত্র কৃষক সমবায়ের নামে তেভাগা আন্দোলন করেছিলেন। তারপর আরেক সমবায় উদ্যোক্তা ড. আখতার হামিদ খান ১৯৫৯-৬০ সালে কুমিল্লা জেলায় কৃষকদের সংগঠিত করে তাদের কল্যাণার্থে সমবায়ের সুফল ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘কুমিল্লা মডেল’ চালু করেন। এটিই ১৯৬০ সালে সমবায়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হিসেবে কুমিল্লার কোটবাড়িতে ‘বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলাপমেন্ট (বার্ড)’ স্থাপিত হয়। এর কাজ মূলত গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করে তাদের মাধ্যমেই দারিদ্র্য বিমোচন করা।
একই ধারণা থেকে পরবর্তীতে বগুড়ায় ‘রুরাল ডেভেলাপমেন্ট একাডেমি (আরডিএ)’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এগুলোর ভিত্তি হিসেবে দেশে এখন হাজারো বেসরকারি সমবায়ী প্রতিষ্ঠান (এনজিও) গড়ে উঠেছে, যারা সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে দেশের সমবায় আন্দোলনের জন্য কাজ করছে। বর্তমানে সরকার দেশের সমবায়ীদের উপকারার্থে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি বিগত দিনের সফলতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিনে দারিদ্র্য বিমোচনে আরো কার্যকর পদক্ষেপ রাখার জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। এ প্রকল্পটির উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখতে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে দেশের ১০০টি উপজেলায় ব্যাংকটির ১০০টি শাখা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন। অবশিষ্ট ৩৮৫টি উপজেলায় শাখা খোলার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯০টি উপজেলার চার হাজার ৫৫০টি ইউনিয়নে ৪০ হাজার ৯৫০টি ওয়ার্ডে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে একটু সহজ হচ্ছে, কারণ এটি একটি সমন্বিত সমবায় খামার উন্নয়ন প্রকল্প। এ সমবায়ের মাধ্যমে একটি বাড়িতে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। নির্বাচিত একটি বাড়ির জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি, ধানসহ অন্যান্য ফসল, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গরু, ঘরে ছাগল, হাঁস-মুরগি, বাড়ির চারপাশে বনজ, ফলজ, ঔষধি গাছপালা রোপণ ইত্যাদি প্রত্যেকটি সেক্টরে সহযোগিতা দেওয়া হয়ে থাকে।
সেখানে এগুলোর পাশাপাশি বাড়িতে ছেলেমেয়েদের জন্য লেখাপড়া, বাড়িতে বেকার পুরুষদের জন্য ছোট-খাটো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে এবং মহিলাদের জন্য তাদের উপযোগী কাজ যেমন সেলাই, বাঁশ-বেতের কাজসহ অন্যান্য আরো অনেক ধরনের আয় বর্ধনমূলক কাজে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এভাবেই সমবায়ের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে কাজ করলে দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদান রাখবে এটাই আজ ৪৫তম সমবায় দিবসে প্রত্যাশিত।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়