ফারাক্কা দিবস
‘হক কথা’ কেউ শুনছে কি?
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/16/photo-1431778592.jpg)
‘ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।’ কথাগুলো ৩৯ বছর আগে বলেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মজলুম জননেতার এই ভবিষ্যদ্বাণী যে এত নির্মমভাবে বাস্তবে পরিণত হবে সেটা উপলব্ধি করার মতো দূরদর্শিতা তৎকালীন কর্তাব্যক্তিদের ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। যে প্রমত্ত পদ্মা নদীর ‘সর্বনাশা’ রূপ নিয়ে লেখা হয়েছিল বিস্তর গান-কবিতা; সেই পদ্মা নদীর একটি বিশাল অংশ আজ ধূসর মরুভূমি। মাঝেমধ্যে এখানে-ওখানে মরীচিকার মতো মেলে জলের দেখা।
এমন পরিণতির কথা আশঙ্কা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজারো মানুষের মিছিলে। ৩৯ বছর আগের এই দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান থেকে শুরু হয়েছিল সেই লংমার্চ। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ তাঁরা পৌঁছেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখানে রাত্রি যাপনের পর পরের দিন সকাল ৮টায় আবার শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে যাত্রা। মহানন্দা নদী পার হওয়ার জন্য হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃত্রিম সেতু তৈরি করেছিলেন নৌকা দিয়ে। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই লংমার্চ সমাপ্ত হলেও বিপুল মানুষের ঢল দেখে সেদিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল ভারতীয় সীমান্তে। কানসাটের জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে।’
বাংলার এই মজলুম জননেতার কথাটি অবশ্য সত্য হয়নি। ১৯৭৬ সালেরই ১৭ নভেম্বর পরলোকে চলে যান ভাসানী। আর তাঁর প্রতিরোধের অধ্যায় থেকে যায় অসমাপ্ত। ফারাক্কা টিকে থাকে, আরো শক্তিশালী হয়। আর প্রয়োজনে পানি পায় না বাংলাদেশের মানুষ। অসময়ের স্রোত আবার ভাসিয়ে নিয়ে যায় ফসলি জমি, ঘরবসতি।
আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন ও ভাগাভাগি নিয়ে দেশে দেশে যে বিরোধ বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম হলো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন-সংক্রান্ত বিরোধ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ভারত। ১৯৫১-৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই দশক ধরে আলোচনা হলেও কোনো কার্যকর সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার শুরু হয় আলাপ-আলোচনা। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা বাঁধ সাময়িকভাবে চালুর ব্যাপারে স্বাক্ষরিত হয় একটি অন্তবর্তীকালীন চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী বাঁধটি চালু করার কথা ছিল এক মাস ১০ দিনের (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে, ১৯৭৫) জন্য। কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ফারাক্কা বাঁধের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে ভারত। প্রতিবেশী দেশের অনায্য আচরণের বিরোধিতা করে এক বছর পর ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন মওলানা ভাসানী।
কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন-সংক্রান্ত ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে। কিন্তু সেই চুক্তিরও ছিল নানান সীমাবদ্ধতা। ফলে একতরফাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই গেছে ভাটির অঞ্চল বাংলাদেশ। নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেচকাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে কৃষকরা। তাতে যেমন বেড়েছে কৃষিব্যয়, তেমনি নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। গত কয়েক বছরে এলাকাভেদে পানির স্তর নেমে গেছে ২৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত। খরা, দাবদাহ বেড়েই চলেছে প্রতি বছর। আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছে নদীপারের অনেক মানুষ।
১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর লংমার্চ স্মরণে ১৬ মে পরিচিতি পেয়েছিল ‘ফারাক্কা দিবস’ হিসেবে। কিন্তু সংগ্রামী এই জননেতার শেষজীবনের কথাগুলোও আজ বিস্মৃতির পথে। ভাসানীর ‘হক কথা’ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে কালের গর্ভে। আর এভাবে চলতে থাকলে, ২০২৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই হয়তো শুকিয়ে যেতে পারে খালে পরিণত হওয়া নদীগুলোর পানিও।
১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন সহসভাপতি ইসমাইল সেরাজেলদিন বলেছিলেন, ‘এই শতাব্দীতে মানুষ যুদ্ধ করছে তেলের জন্য। কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীতে যুদ্ধ হবে পানির অধিকার নিয়ে।’ তেমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মুখে দাঁড়ালেই কি কেবল মনে পড়বে মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’গুলো?
লেখক : সাংবাদিক