৭ নভেম্বর
জাতি সত্তার মিলন মোহনা
তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জাতিসমূহ অব্যাহতভাবে জাতি সত্ত্বার সংকট মোকাবিলা করে আসছে। রুপার্ট এমারসন এসব জাতিসমূহকে বলছেন, ‘Nations in hope’বা আশান্বিত জাতি। জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণতায় উত্তরণের পূর্বে যে জাতি ‘রাষ্ট্র ব্যবস্থা’ অর্জন করেছে, তারা স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে জাতিগঠন প্রক্রিয়ার (Nation building process) মাধ্যমে অভীষ্ঠ জাতি সত্ত্বা নির্মাণের জন্য নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মাধ্যেমে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে যে দুটো জাতিরাষ্ট্রের (National state) আবির্ভাব ঘটে তার একটি পাকিস্তান। অপরটি হিন্দুস্থান। প্রথমটি মুসলমানদের আর দ্বিতীয়টি হিন্দুদের। এমন সরলীকরণ জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য অনুকূল নয়। পাকিস্তান যেখানে একটি অখণ্ড সত্তা নির্মাণে ব্যর্থ হয়, সেখানে হিন্দুস্তান ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ (Unity in diversity) অর্জন করে।
১৯৭১ সালে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং কাঙ্ক্ষিত জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের ব্যর্থতায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ তার স্বাধীন সত্ত্বা অর্জন করে। সেক্ষেত্রে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলী- ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬৬-এর স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন এবং অবশেষে ১৯৭০ এর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যেমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্রমবিকাশ ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত শাসন শোষণ এবং ত্রাসণ- জাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে স্বাভাবিক স্রোতধারা সংযোজন করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়।
জাতীয়তাবাদ বা জাতি সত্তার ধারণাটি বহুমাত্রিক। ইতিহাসের বহু বাঁক অতিক্রম করে একটি জাতীয়তাবাদের ঊন্মেষ ঘটে। আর জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি বহতা নদীর মতো। যেমন, ব্রহ্মপুত্র নদী তিব্বতের সানপো নামক জলপ্রভাত থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে যমুনা নাম ধারণ করেছে। এরপর এ নদী পদ্মা নাম ধারণ করে চাঁদপুরের নিকট মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। অতপর মেঘনা নামেই বঙ্গপোসাগরে পতিত হয়েছে। এভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনা বহু বাঁক, গিরি-দড়ি-বন এবং অনেক পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে একটি সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের ইতিহাসও হাজার বছর ধরে আবর্তিত-বিবর্তিত এবং আন্দোলিত হয়েছে। প্রচীন বঙ্গ থেকে বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়, স্বাধীন সুলতানী আমল থেকে আকবরের সুবহে বাংলা, আলীবর্দী খাঁর বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বকীয়তা এবং ব্রিটিশদের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি- এসবই ইতিহাসের এক একটি মাইল ফলক। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে সর্বভারতীয় চেতনার উম্মেষ ঘটে ‘হিন্দুতভা’ এর প্রভাবে তা বিনষ্ট হয়। গড়ে ওঠে এর বিপরীতে সর্ব ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এই বাংলাদেশেই রচিত তার ভিত্তিভূমি। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। ১৯৪০ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ দেশের জনগণের প্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপন করেন ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব।
এ প্রস্তাবে ভারতের পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলে পৃথক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। পরবর্তীকালে বাংলার মুসলমানদের স্বকীয় সত্ত্বা নিয়ে একটি স্বধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এ অঞ্চলের মুসলিম নেতাদের ব্যর্থতা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে। এ বিষয়ে শেরে বাংলার বিস্ময়কর নীরবতা এবং দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ‘বোস- সোহরাওয়ার্দী পরিকল্পনা’ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক বাস্তবতায় ১৯০৫ সালে অগ্রসর বাঙালি হিন্দু সমাজ মুসলিম স্বার্থের অনুকূল নতুন প্রদেশ ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’কে বঙ্গমাতাকে দ্বিখণ্ডন মনে করে। বিস্ময়ের ব্যাপার সেই একই সম্প্রদায় ১৯৪৭ সালে বঙ্গমাতাকে অখণ্ড রাখার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে। উত্তর খুঁজতে গেলে হিন্দু মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারায় প্রমাণ মিলবে। সে সময়ে সর্ব ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্ব পশ্চিমাদের হাতে থাকলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী অগ্রপ্রথিকের ভূমিকা পালন করে। এসব ঘটনা পরম্পরায় এতদ্বাঞ্চলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের সুদৃঢ় ও সুগভীর ভিত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিমাদের সাথে একত্রিত হয়ে বাংলার মুসলমানরা যে পাকিস্তান গড়েছিল মাত্র ২৩ বছরে সে সম্পর্কে তাদের মোহ মুক্তি ঘটে। পাকিস্তান নেতৃত্বের অভিন্ন জাতিগঠনে ব্যর্থতা এবং এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি শোসন-বঞ্চনা, অন্যায় অবিচার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটায়। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন কীভাবে স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয় তা সবারই জানা কথা। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথমিক শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবাদের অপর অনিবার্য অনুষঙ্গ মুসলিম সত্ত্বাকে অস্বীকার করে। বরং তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মহান প্রতিবেশীর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বাংলাদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। সর্বত্র মুসলিম পরিচয় মুছে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এ অবস্থায় আড়ালে-আবডালে মুসলিম বাংলার স্লোগান ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়। বসন্ত চ্যার্টাজি তার Inside Bangladesh গ্রন্থে তা প্রত্যক্ষ করেন। ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বলে অভিহিত করতে থাকেন। একদল রাষ্ট্র বিজ্ঞানীর বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে যে `When the desired nationalism is achieved the past sentiment became prominent’(Hafiz and Rob, eds, Nation Building in Bangladesh; BIISS, Dhaka 1986)
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলীর পর সামরিক বাহিনীতে সিনিয়র জুনিয়র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পেক্ষাপটে একটি অস্থির পরিবেশকে কাজে লাগাতে চায় জাসদের ‘গণবাহিনী’। খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান ভারতপন্থী তথা পূর্বেকার শাসনে প্রত্যাবর্তন এ রকম লিফলেট বিতরণ করে তাদের ভাষায় ‘বিপ্লব’-এর মহড়া দেয় গণবাহিনী। কিন্তু বিধি বাম। এরইমধ্যে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করার ফলে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। গণবাহিনীর লঘিষ্ঠ অংশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্লোগান দিলেও গরিষ্ঠ অংশ উচ্চারণ করে ‘আল্লাহু আকবার’। ব্যর্থ হয় তথাকথিত বিপ্লব, ঈদের মতো খুশি ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা শহরে। মানুষ ‘মিছিলের স্রোত আর উল্লাস’ দিয়ে বিপ্লবকে স্বাগত জানায়। (সম্পাদকীয় মন্তব্য, দৈনিক ইত্তেফাক ৮ নভেম্বর ১৯৭৫)
সিপাহী জনতার এই বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের মিলন মোহনায় উপনীত হয়। অবিভক্ত ভারতের মুসলিম জাতীয়তাবাদ আর পাকিস্তান আমলের বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি স্বাভাবিক মিথস্ক্রিয়া ঘটে। শহীদ জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদের সব উপাদান-ভাষা, ধর্ম, নৃতত্ত্ব এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আলোকে নির্ণয় করেন নতুন জাতীয়তাবাদ : বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। ইতিহাসের ফল হিসেবে ৭ নভেম্বর ৭৫-এর ‘বিপ্লব ও সংহতি’ আমাদের পৌঁছে দিয়েছে জাতীয়তাবাদের সেই মোহনায় ‘মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী যেথা এক সাথে হলো লীন।’
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক , অধ্যাপক সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়