৭ নভেম্বর
বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের ইতিহাস
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল সময়। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যের ভিত্তিতে দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র একে ভুলুণ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে সদা তৎপর ছিল। তারা সকলেই একটি সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুণছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেরকম একটি সুযোগ সৃষ্টি করে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।
সেই হত্যাকাণ্ডের পর তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত, নিরাপদ, নিষ্কন্টক ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ২ মাস ১৮ দিন পর ৩ নভেম্বর জেলখানার ভিতরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। তখন সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসেবে যাঁরা অকপটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস রেখে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছিলেন, তাঁরা আস্তে আস্তে সংগঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চারনেতা হত্যার বিষয়ে প্রতিবাদ ও পরবর্তীতে আরো যেকোনো ধরনের অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছিলেন। কারণ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেকদের ধারণামতে, একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পাল্টা আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানই হতে পারে বিকল্প ব্যবস্থা। সেই মিশনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত প্রধান তিনটি ফোর্সের একটি অর্থাৎ ‘কে’ ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন (মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস-ফোর্স, মেজর জিয়ার নেতৃত্বে জেড-ফোর্স এবং মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে-ফোস)।
তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরই জেলখানায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ায় খালেদ মোশাররফ তখন দেখলেন যে সেনাবহিনীতে চেইন অব কমান্ড মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক, রশিদ, ডালিম গংরা একের পর এক অন্যায় করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছেন এবং চিফ অব স্টাফ কোনো ভূমিকা পালন করছেন না, তখনই খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। অপরদিকে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে তাঁর অনুসারী কিছু সৈন্য এবং জাসদের কর্মীবাহিনী মিলে ক্যান্টনমেন্টে খন্দকার মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করতে থাকে। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সপক্ষের একটি ক্যু করা চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্রকারীদের একটি অংশ তা টের পেয়ে আগে থেকেই সামরিক ও বেসামরিক কিছু লোককে সাথে নিয়ে তারই পাল্টা ক্যু করে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এবং খালেদ মোশররফকে বন্দি করে পরে হত্যা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর তারিখে বিপ্লব প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে যে ঘটনার জন্ম হয়েছিল তাকেই বিএনপি ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ পালন করে থাকে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রগতিশীল ধারাগুলো এ দিনটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য হত্যা দিবস’ পালন করে থাকে। সেই ৭ নভেম্বরের পরে আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের যে অংশ বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিল তাদের মার্শাল ল ‘ক্যাঙ্গারু ট্রায়ালের’ মাধ্যমে কর্নেল তাহেরসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যকে প্রহসনের বিচারের নামে মূলত হত্যা করা হয়। পরে দেশে অসাংবিধানিক পন্থায় শাসন চালু করা হয়, যেখানে হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। তখন জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। তাঁর কিছু দিন পর সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পড়ে এ এস এম সায়েম অসুস্থতার অজুহাতে স্বীয় দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানালে জেনারেল জিয়া নিজেই রাষ্ট্রপতি হন।
এসব ইতিহাস তৎকালীন বাংলাদেশে অবস্থানরত সাংবাদিক ‘মাসকারেনহ্যাস’ তাঁর লেখা বইয়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই আসলে দেশে হত্যা, পাল্টা হত্যা ও ক্যু-এর রাজনীতি শুরু হয়েছিল। আর তারই ধারাবাহিকতায় দেশে যে ধরনের শাসনের শুরু হয়, সেটার কারণে ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও আততায়ীর বুলেটে জীবন দিতে হয়, বলে রাজনৈতিক বিশ্লেকরা মনে করেন। তারপর একেবারে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর জের টানতে হয়েছে দেশকে। কিন্তু অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর দেশে প্রায় ২৫ বছর ধরে যে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়