প্রাণীপ্রেম
প্রাণীদেরও ভালোবাসা প্রয়োজন
দুই মাস আগের কথা, ঘটনাস্থল মতিঝিলের এজিবি কলোনির আল হেলাল জোন। ঈদের দুদিন আগের ঘটনা। এক মাকে কিছু পাশবিক মানুষের হাতে নির্মম, নৃশংসভাবে জীবন দিতে হলো। তার অপরাধ ছিল তার চোখ না ফোটা ফুটফুটে বাচ্চাগুলোকে মানুষের অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করা। সেই মা ছিলেন কুকুর প্রজাতির। হোক সে কুকুর, তবুও মা তো।
তার ১৫ দিন বয়সী চারটি বাচ্চাকে নিয়ে সে রোদ পোহাচ্ছিল রাস্তার পাশে। কিন্তু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অনেকেই অহেতুক পশুদের ভয় দেখায় বা বিরক্ত করে। কুকুর বাচ্চাগুলোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু নিজ সন্তানদের কথা চিন্তা করে এক মহিলাকে কামড় দিয়ে বসে মা কুকুরটি। এ খবর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে কলোনিতে। মানুষের মাঝে অমানুষ জেগে ওঠে। এত বড় সাহস! প্রভুতুল্য মানুষকে কামড় দিয়েছে এক সামান্য কুকুর। সভ্য মানুষের বিবেচনায় রায় হলো, নিজ সন্তানকে বাঁচাতে মানুষকে সামান্য কামড় দেওয়ার শাস্তি একটাই, আর তা হলো মৃত্যুদণ্ড।
হাতে বাঁশ, লাঠি নিয়ে নেমে পড়ল এলাকার মানুষ। পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো মা কুকুরটাকে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। শুধু মাকে মারলেই তো আর হবেনা, ফুটফুটে শিশুগুলোকেও চোখ মেলে তাকানোর আগেই শেষ করে দিতে হবে। আর তাই মায়ের মৃতদেহের উপরে শিশুগুলোকে রেখে তাদের উপর আর্বজনা ফেলে চাপা দিল। সেই কলোনিরই একজন চুপিচুপি এই ঘটনার কিছু ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ল ‘কেয়ার ফর প’জ’, ‘পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার’, ‘রাইজ ফর প’জ’, ‘এনিমেল কেয়ার সোসাইটি অব বাংলাদেশ’, ‘এনিমেল লাভারস অব বাংলাদেশ’, ‘এনিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ’সহ ফেসবুকের বিভিন্ন প্রাণীপ্রেমী সংগঠনের গ্রুপে।
প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠল। ব্যাংকার তারেক, কেয়ার ফর পজের সৌরভ শামীম ও জাহিদ হোসেন সাথে সাথে ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে। এক বুক আশা নিয়ে ডাস্টবিনের ময়লার স্তূপে তন্য তন্য করে খুঁজে দেখলেন, বাচ্চাগুলো যদি বেঁচে থাকে এই আশায়। বেঁচে আছে, তিনি দুটি বাচ্চাকে জীবিত উদ্ধার করলেন, নিয়ে এলেন মোহাম্মদপুরের বসিলায় অবস্থিত ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কেয়ার ফর পজের সেন্টারে।
নিজ উদ্যোগে কথা বলেন কলোনির সভাপতির সাথে, ঘটনার ভয়াবহতা তুলে ধরলেন, প্রতিবাদ জানালেন এই নৃশংসতার। এই ঘটনা প্রাণীপ্রেমীদেরকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। দলমত নির্বিশেষে সব প্রাণীপ্রেমী সংগঠনের সব সদস্যদের একজোট হওয়ার আহ্বান জানান পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি রকিবুল হক এমিল। ঘোষণা দেন ওয়ার ফর এনিমেল লিবারেশনের। সেই বোবা নিষ্পাপ মা কুকুর ও তার সন্তানদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে প্রাণীপ্রেমীদের জড়ো হওয়ার আহবান করেন এজিবি কলোনি প্রাঙ্গণে।
প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান, মানুষের পাশাপাশি কুকুরদেরও আছে বেঁচে থাকার সমান অধিকার। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাণীপ্রেমীরা একে একে জড়ো হতে শুরু করেন এজিবি কলোনি মাঠে। একজন দুজন করে জড়ো হলেন ৩৫ জন। সবাই মিলে চললেন কলোনির ক্লাব ঘরে। সেখানে কলোনির কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে আলোচনায় বসলেন। সবার কণ্ঠেই প্রতিবাদের সুর। সবাই এই ঘৃণ্য কাজের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করলেন।
ঘটনার বিবরণ শুনে কলোনির সেক্রেটারি ব্যথিত হলেন এবং নিজেও এই কাজের নিন্দা জানালেন, দুঃখ প্রকাশ করলেন, কলোনির পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আশ্বাস দিলেন তাঁর এলাকায় আর কোনো কুকুরকে মেরে ফেলা হবে না। কুকুর নিধনে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পরবর্তী সময়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন সবাইকে।
তবে মানুষের অজ্ঞতা ও ভয় দূর করার জন্য সেক্রেটারি প্রাণীপ্রেমী সংগঠনের সদস্যদের অনুরোধ জানান যত দ্রুত সম্ভব তার এলাকার কুকুরগুলোকে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক টিকা প্রদান ও কুকুর বিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর।
এবারে প্রাণী কল্যাণ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো একত্রে সুদূর প্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে রকিবুল হক এমিল গাবতলীতে অবস্থিত পিপলস ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ারের এনিমেল শেল্টারে সব প্রাণীপ্রেমীদের একত্রিত হয়ে মুক্ত আলোচনার আমন্ত্রণ জানান। সেখানে প্রায় ৭০ জন প্রাণীপ্রেমী একত্রিত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে মতামত দেন। সিদ্ধান্ত হয় যত দ্রুত সম্ভব মতিঝিল এজিবি কলোনিতে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করবে কেয়ার ফর প’জ এবং সেখানে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাবে পিপলস ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার।
পরবর্তী সপ্তাহে মোহম্মদপুরের বসিলায় অবস্থিত কেয়ার ফর পজের এনিমেল সেন্টারে আরো একটি মিটিং ডাকা হয় যেখানে প্রায় শ খানেক প্রাণীপ্রেমীর সমাবেশ ঘটে। সেই সাথে এনিমেল ওয়েলফেয়ার সম্পর্কিত সব সংগঠনের ফেসবুক পেজে চলে প্রচারণা ও জনসংযোগ। পরপর কয়েকটি সমাবেশের পর প্রাণীপ্রেমীদের মাঝে এক ধরনের কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ অক্টোবর পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ারের উদ্যোগে সাতজনের একটি দল কুকুরের টিকাদান কর্মসূচির জন্য মতিঝিল এজিবি কলোনিতে কুকুরশুমারির কাজ সম্পন্ন করে।
কেয়ার ফর প’জ প্রস্তুতি নিতে শুরু করে কুকুরের টিকাদান কর্মসূচির। অবশেষে গত ৪ নভেম্বর সকাল ১০টায় কেয়ার ফর পজের প্রায় ২৯ জন তরুন প্রাণীপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবী মতিঝিল এজিবি কলোনিতে উপস্থিত হন কুকুর টিকাদান ও গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনার উদ্দেশ্যে।
বাংলাদেশে দুঃস্থ, অসহায় পথ প্রাণীদের নিজ কাজ করার অন্যতম দুজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি সৌরভ শামীম ও জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে ২৯ জন স্বেচ্ছাসেবী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে সমগ্র এজিবি কলোনীর আল হেলাল জোন, আইডিয়াল জোন ও হাসপাতাল জোনের প্রতিটি রাস্তা ধরে খুঁজে খুঁজে কুকুরদের বের করে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক টিকা প্রদান করে। অংশগ্রহণকারীরা এতটাই উৎসাহী ছিল যে, সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝেও তারা টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যায়।
কাজগুলো কিন্তু মোটেও সহজ ছিলনা। বেশির ভাগ কুকুরই অপরিচিত মানুষের কাছে আসতে চাচ্ছিল না। কেউ ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল, কেউ আবার ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসছিল। তরুন দল দুটির সদস্যরা বিভিন্নভাবে বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে কিংবা আদর করে কাছে ডেকে আনছিল। যেসব কুকুরের টিকা দেওয়া হয়ে যায়, তাদের গলায় চিহ্নস্বরুপ বেল্ট পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এভাবে বিকাল পর্যন্ত একে একে মোট ২৯টি কুকুরকে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক টিকা প্রদান করা হয়।
মজার ব্যাপার হলো যেখানে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ কুকুরকে ভয় পায়, সেখানে প্রাণীপ্রেমীদের এই দলে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও কুকুরকে ডেকে আদর করছে, বেল্ট পরাচ্ছে, কুকুর ধরার জন্য ময়লা-আবর্জনায় দৌড়ে বেরিয়েছে। দেখে মনেই হয়নি তাদের মাঝে কুকুর ভীতির লেশমাত্র রয়েছে।
কুকুর ধরায় ব্যস্ত পেশায় ডেন্টিস্ট প্রিদিয়া চৌধুরী ছোটবেলায় কুকুরকে খুব ভয় পেলেও একবার রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা এক কুকুরের প্রতি মায়াবশত সাহস করে নিজ হাতে তুলে পশুর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই ভয় একেবারেই উঠে গিয়েছে। মানুষ নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে কিন্তু কুকুর-বিড়ালের মতো বোবা প্রাণীগুলো তা করতে পারে না। ওদের নিরাপত্তার দিকটি মানুষকেই দেখতে হবে এই তাড়না থেকেই ড. প্রিদিয়া যতটুকু সম্ভব প্রাণীদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন, আর ১০ জন নারীর মত ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকেননি।
কুকুরের পেছনে ছোটার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় শিশুদের কাছে কেয়ার ফর প’জ এর সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরন ও কুকুর বিষয়ক বিভিন্ন বিষয় বোঝাতে ব্যস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকের ছাত্রী সুমাইয়া কবির ছোটবেলা থেকেই পথের কুকুর-বিড়ালদের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করেন। অভিভাবকেরা ছোট শিশুদের মনে রাস্তার কুকুর-বিড়ালের প্রতি অহেতুক যে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে তা তার কাছে কখনোই যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। টিকাদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পেরে তিনি বেজায় খুশি, ভবিষ্যতেও সুযোগ পেলে পথের অসহায় প্রাণীদের জন্য কাজ করার ইচ্ছে আছে তার।
আরেক প্রাণীপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবী দ্বিপান্বিতা রিদি পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার। নিজেই খুলেছেন অসহায় প্রাণীদের জন্য এএলবি শেল্টার নামের আশ্রয়কেন্দ্র।
এভাবে প্রাণীপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবীরা মিলেমিশে সারাদিন কুকুর টিকাদানের পাশাপাশি এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে কুকুর সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারনা ও ভয়গুলো শুধরে দেয়। এলাকাবাসী অনেকেই উৎসাহের সাথে স্বেচ্ছাসেবী দলটিকে সহায়তা করে। অনেক পথশিশুরা কোথায় কোথায় কুকুর পাওয়া যাবে তা দেখিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে সবার সহযোগিতায় কুকুরকে টিকাদানের মাধ্যমে মতিঝিল এজিবি কলোনির অসহায় কুকুরগুলো যেমন একদিকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পেল, তেমনিভাবে এলাকার মানুষও জলাতঙ্ক থেকে নিরাপদ হলো, সেই সাথে তাদের মাঝে কুকুর বিষয়ক সচেতনতা তৈরি হলো।
অহেতুক ভয় না পেয়ে আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি এই অসহায় প্রাণীগুলোকে কিছুটা আদর-ভালোবাসা দেয়, তাদের দৈনন্দিন ফেলে দেওয়া খাবারের কিছু অংশ যদি তাদের খেতে দেয় তাহলে অসহায় প্রাণীগুলো মানুষের সাথে ভালোভাবে সহাবস্থান করতে পারে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের মানুষের মতো সেই অসহায় প্রাণীগুলোরও আছে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, মায়া-মমতা, ভালোবাসার অনুভূতি। প্রতিটি প্রাণীরই রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার, প্রতিটি প্রাণই মহামূল্যবান। আর সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদেরই করে দিতে হবে তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা।
লেখক : পুরাতত্ত্ববিদ ও প্রাণী কল্যাণকর্মী।