অভিমত
শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক আমরা কেমন দেখতে পাচ্ছি? আর কী রকমই বা হওয়া উচিত ছিল তা জানার আগে কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। সেগুলো হতে পারে শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দুজনের কথা বলা হলেও আদতে তাঁরা হলেন তিনজন; শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবক। শিক্ষার সঙ্গে এই তিনজনের সম্পর্ক নিয়ে বব বেয়াউপ্রেজ নামক একজন মার্কিন ব্যক্তিত্ব বলেছেন ‘শিক্ষা হলো একজন নিবেদিত শিক্ষক, একজন অনুপ্রাণিত ছাত্র এবং একজন উদ্যমী অভিভাবকের মিলিত প্রতিশ্রুতি।’ বব বেয়াওপ্রেজের কথা থেকে বোঝা যায়, এই তিন প্রতিশ্রুতির সংমিশ্রণই হলো শিক্ষার মূল শক্তি।
তিনজনের মিলিত প্রতিশ্রুতি যদি সঠিক দিকে ধাবিত হয় তখনই একজন ছাত্র সফল হতে পারবে, অন্যথায় নয়। অন্যদিকে এই মিলিত প্রতিশ্রুতির সঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এসে পড়ে, সেটা হলো এই তিনজনের ইন্টারঅ্যাকশন বা মিথস্ক্রিয়া। যদি এই তিনজনের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশন না হয় কিংবা নিদেনপক্ষে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে যদি কার্যকরী ইন্টারঅ্যাকশন না হয়, তা হলে ছাত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
ইন্টারঅ্যাকশন বা মিথষ্ক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত অর্থ হলো, ‘পারস্পরিক ক্রিয়া বা প্রভাব।’ ইন্টারঅ্যাকশন শব্দটি এসেছে লাতিন ‘ইন্টার’ মানে ‘দুয়ের মধ্যে’ এবং ‘এগো’ মানে ‘কিছু করা অথবা আচরণ করা’ শব্দগুলো থেকে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মাঝে ইন্টারঅ্যাকশন হয়েছে এমন কথা তখনই বলা যাবে, যখন তাদের মাঝে চারটি ক্রিয়া সংগঠিত হবে। এগুলো হলো : ১. কথা বলা বা আলাপ-আলোচনা করা, ২. পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময়, ৩. পরস্পরের সঙ্গে ভাববিনিময়, এবং ৪. পারস্পরিক যে কোনো অ্যাকশন বা কাজে লিপ্ত থাকা। এই চার উপাদানের একটির অভাব থাকলে কার্যকরী বা অর্থপূর্ণ ইন্টারঅ্যাকশন হবে না।
একজন ছাত্রের জীবনে বিভিন্ন ধাপে এই ইন্টারঅ্যাকশনের পরিবর্তন ঘটে। প্রাইমারি পর্যায়ে একজন ছাত্রের সঙ্গে একজন শিক্ষকের যে নিবিড় ইন্টারঅ্যাকশন থাকে বা হওয়ার সুযোগ রয়েছে, পর্যায়ক্রমে হাইস্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তেমনটি রাখা সম্ভব হয় না।
অন্যভাবে বলতে গেলে সুযোগ থাকলেও রাখা হয় না; কিংবা সুযোগই থাকে না। এখানেই ইন্টারঅ্যাকশনের টার্নিং পয়েন্ট নিহিত। উদাহরণস্বরূপ আমরা প্রাইমারি ও হাইস্কুল পর্যায়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বিভিন্ন আঙ্গিকে ইন্টারঅ্যাকশন করার সুযোগ পেয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে আমাদের গ্রামের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে শহরের কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে। একে তো সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, অন্যদিকে অতিরিক্ত ছাত্রসংখ্যার মাঝে আমরা হারিয়ে গিয়েছি। আমাদের কলেজে খোদ বিজ্ঞান বিভাগে দুই সেক্শনে ৩০০ জন ছাত্র মিলে মোট ছাত্রসংখ্যা ছিল ৬০০ জন। ফলে ইন্টারঅ্যাকশনের চারটি উপাদানের একটিও আমাদের ও শিক্ষকের মাঝে হওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা শিক্ষকদের চিনতাম হালকাভাবে; আর শিক্ষকরা আমাদের মোটেই চিনত না। এরই মাঝে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা এসে ধরা দিল। শহরের নামিদামি স্কুলের ছেলেরা সঙ্গত কারণেই আমাদের চেয়ে একটু বেশি তৎপর হওয়ায় আমরা সামনের দিকের বেঞ্চগুলোতে বসার তেমন সুযোগ পেতাম না। ফলে একধরনের অবহেলা ও হতাশার অনুভূতি আমাদের মাঝে কাজ করত। ফলস্বরূপ যা হওয়ার তাই হলেঅ। লেখাপড়া বাদ দিয়ে আমরা সময় ব্যয় করতে শুরু করলাম সিনেমা দেখা আর অন্যান্য আনন্দ-ফুর্তিতে। তার পরিনাম হলো এসএসসি পর্যায়ে ভালো ফলাফল করলেও এইচএসসি পর্যায়ে আশানুরূপ ভালো না করা।
এইচএসসি এমন একটি পর্যায়, যেখানে ভালো ফলাফল না করলে জীবনের লক্ষ্যই পরিবর্তন হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে দেখুন, অনেক ছাত্রের জীবনে এভাবেই লক্ষ্যচ্যুতি ঘটেছে। সুতরাং এ পর্যায়ে এসে একজন শিক্ষকের তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে বিভিন্ন ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে তাদের সঠিক লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করার গুরুত্ব কী অপরিসীম তা সহজেই অনুমেয়। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়া, তাদের লেখাপড়ার খোঁজ নেওয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ড বা ইন্টারঅ্যাকশন একজন ছাত্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। শিক্ষকদের এহেন নিবিড় অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তাদের উচ্ছন্নে যাওয়া থেকে বিরত রাখবে।
উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড (১৯২১-১৯৯৪) নামক একজন আমেরিকান লেখক চার ধরনের শিক্ষকের কথা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই চার ধরনের শিক্ষকের কর্মধারাও আবার চার ধরনের। যেমন ১. একজন মাঝারি মানের শিক্ষক ক্লাসে শুধু কথা বলেন, ২. একজন ভালো মানের শিক্ষক কথা বলার মাঝে ব্যাখ্যাও করেন, ৩. একজন উচ্চতর মানের শিক্ষক কথা ও ব্যাখ্যা করার সময় ডেমোন্সট্রেট বা প্রদর্শনও করে থাকেন, আর ৪. একজন মহৎ শিক্ষক এসব কিছুর মাঝে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধও করে থাকেন। একজন শিক্ষকের সঙ্গে আরেকজন শিক্ষকের মাঝে এমন করেই পার্থক্য ঘটে থাকে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেমন হওয়া উচিত ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেকে বলেছেন তাদের মাঝে হওয়া উচিত বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এমনটা অগ্রাহ্য করা না গেলেও এই বন্ধুত্বের মাঝেও একটা সীমা রেখা থাকা উচিত বলে আবার অনেকে মনে করেন। যেমন আমার এক সহকর্মীর মতে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে সম্পর্ক হওয়া উচিত ‘ফ্রেন্ডলি’ কিন্তু ‘ফ্রেন্ড’ নয়। শিক্ষকরা হবেন প্রথমে অভিভাবক, তারপর বন্ধু। ফলে অভিভাবক ও বন্ধুত্বের একটি মিশ্রণ থাকবে শিক্ষকের আচরণের মাঝে। একজন শিক্ষককে তার ক্লাসের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গেই সমানভাবে ইন্টারেক্ট করতে হবে। তা না হলে কার্যকরী রেজাল্ট আনা সম্ভব নয়।
এখন প্রশ্ন হলো কোনো একটি ক্লাসে যদি অনেক ছাত্র থাকে, তা হলে এটা সম্ভব কি না। জবাব হলো, আসলেই সম্ভব নয়। আর তাই প্রতিটি ক্লাসে কী পরিমাণ ছাত্র থাকবে তা নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। উদাহরণস্বরূপ একটি বিবিএ অথবা এমবিএর ক্লাসে ৩০ জনের বেশি ছাত্র থাকলে ছাত্র ও শিক্ষকের মাঝে ইন্টারঅ্যাকশনের চারটি উপাদান বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব নয়।
আজকাল পাবলিক কিংবা প্রাইভেট এই উভয় ক্যাটাগরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংখ্যা এত বেশি হয় যে লেখাপড়ার চেয়ে সময় অতিবাহিত করাই যেন মূল উদ্দেশ্য। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তা ভেবে দেখা উচিত। উচ্চশিক্ষা সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে কি না, তা ভাবার বিষয় বৈকি। শুধুমাত্র পয়সা কামানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলা এবং যত ইচ্ছে তত ছাত্র ভর্তি করা উচিত নয়। কর্তৃপক্ষের এখনই ভাবার সময় এসেছে। প্রান্তিক জেলাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় নেই বললেই চলে। অথচ অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঢাকা শহরের প্রতি গলিতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এদের মান দেখার যেন কেউ নেই।
লেখক : মেজর (অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিসনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেটে কর্মরত।