দৃষ্টিপাত
রোহিঙ্গা জীবন : কান্না যার নাম
মিয়ানমারের এখনকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেত্রী নোবেল লোরিয়েট অং সান সু চিকে এ সময় যদি কেউ বিশ্বের কোথাও শান্তি সম্মেলনে বক্তব্য দিতে দেখেন -নিশ্চিত তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না। প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে জিইয়ে রাখা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সমস্যায় এখনো তাঁর সৈন্যবাহিনী বিষের বারুদ ঢেলে যাচ্ছে। পোড়াচ্ছে বাড়ি, উদ্বাস্তু করে দিচ্ছে লাখো মানুষ আর মানুষের প্রাণহরণটা সেখানে এখন রোজকার কর্ম। এতটা অমানবিকতা সত্ত্বেও নির্বিকার সু চি তা চেয়ে চেয়ে দেখে যাচ্ছেন। সু চি না হয় রোহিঙ্গা মানুষ নামের আজন্মের উৎপীড়িতের দুঃখ ভুলে আয়েসে আছেন, কিন্তু বিশ্ব বিবেকের ঘুম কি কোনোদিনই ভাঙবে না?
ঘটনার শুরু সেই ব্রিটিশ কলোনিমুক্ত হয়ে দেশভাগের কালে। রাখাইনরা থাকতে চেয়েছিল পাকিস্তানের পূর্বাংশের সাথে। কিন্তু সেকালের পাকি নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাতে সায় দেননি। এরপর রাখাইন বা আরাকান রাজ্যের স্বাধীনতার দাবিতে তৎকালীন বার্মার সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে রাখাইনরা। আর ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেইযে বার্মার সৈন্যদের অমানবিক অত্যাচার শুরু -এর কোনো রাজনৈতিক সমাধানের পথে না গিয়ে ওই নোংরা ঐতিহ্য খুব বাজেভাবে ধরে রেখেছে বর্তমান সময়ের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কিন্তু একথা মনে রাখা দরকার, আরাকানের বেশির ভাগ মানুষই অতি সাধারণ খেটে খাওয়া। জীবনযুদ্ধের বিভীষিকা পাড়ি দেওয়া সেসব মানুষের সশস্ত্র সংগ্রামে ভাসানোর সুযোগ একদমই নেই। মিয়ানমারের অন্যত্র মুসলিমরা বহাল তবিয়তে থাকতে পারলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না মিয়ানমার। তাদের নেই ভোটাধিকার, নেই পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার কিংবা সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার। একটাই দোষ তারা নিজেদের স্বাধিকার চায়। কিন্তু স্বাধিকার চাওয়াটা মানুষের জন্মগত অধিকার। আমরাও ব্রিটিশ কলোনি কিংবা পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। মিয়ানমারও ব্রিটিশ কলোনি থেকে মুক্ত হয়ে এখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দুর্দশা এটাই যে, গুটিকয়েক অস্ত্রধারীর জন্য পুরো রোহিঙ্গাগোষ্ঠীকেই দেশছাড়া করে ছাড়ছে মিয়ানমার। স্বাধিকার আন্দোলনের নৈতিক দাবিটাকে এখন ধর্মের মোড়কে বন্দি করে ফেলা হয়েছে। অর্ধশত বছর ধরে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে তারা। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে উদ্বাস্তু করেছে লাখো মানুষকে। কয়েক দশক ধরে দেশছাড়া লাখো শরণার্থী জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের টেকনাফে বসবাস করে আসছে। মাঝে মাঝে তাদেরকে নাফ নদ পার হয়ে পুশ ব্যাকের কবলে পড়তে হয়। কিন্তু তারা টেকনাফ ছেড়ে কোনোমতেই আরাকানের নরকে যেতে চায় না।
সম্প্রতি আবারও একই সমস্যা খুব প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। শতাধিক মানুষ হত্যায় হাত রাঙিয়েছে মিয়ানমারের খুনে সেনাবাহিনী। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে হাজারো মানুষের ঘর। নাফ নদ কিংবা বঙ্গোপসাগরে নৌকায় ভাসতে বাধ্য করা হচ্ছে শত শত মানুষকে। নিজ দেশে চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে তারা বাংলাদেশকে তাদের ঠিকানা মানতে চায়! এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের সীমান্ত খোলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের সীমান্তে অধিকসংখ্যক সীমান্তরক্ষী নিয়োগ করে কড়া নিরাপত্তা বসিয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনেই জায়েজ করা আছে যে, কোনো নির্যাতিত নিপীড়িত গোষ্ঠী যদি নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয় তবে প্রতিবেশী দেশে তাদের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আছে। সিরিয়ার হাজারো উদ্বাস্তুদের জায়গা দিচ্ছে ইউরোপ জঙ্গি হামলার বিপদ জেনেও। আমরা রোহিঙ্গাদের ঠাঁই না দেই। কিন্তু এই মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশার কথা আমরা ভাবব না? তাহলে আমরা মানুষ হিসেবে পরিচয় দেই কীভাবে? দিনের পর দিন বিপুলসংখ্যক নারী-শিশু, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ্য কিংবা সন্তানসম্ভবা কোনো মাকে সাগরে ভেসে বেড়াতে হচ্ছে! বিশ্ব মিডিয়াকে পর্যন্ত রাখাইন এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। স্যাটেলাইট ছবিই সংবাদকর্মীদের ভরসা।
রোহিঙ্গারা মুসলিম এটার চেয়েও বড় পরিচয় হলো তারা মানুষ। আর একজন উদারনৈতিক মানুষ হিসেবে আমাকে আপনাকে কোনো উগ্রবাদির দলে না ভিড়ে উৎপীড়িত মানুষের পক্ষেই থাকতে হবে। দেশের নাসিরনগর বা সাঁওতালপল্লিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসের পাশাপাশি প্রতিবাদ করে যেতে হবে বৈশ্বিক অন্যায়ের।
যাঁরা বলেন পূর্বে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এ দেশে সমূহ অপরাধ প্রবণতার সাথে জড়িত, তাদের সাথে দ্বিমত করা যাবে না। কিন্তু এ কথাতেও একমত হতে হবে যে, বিশ্বের সবচে’ নিষ্পেষিত দেশহীন মানুষ রোহিঙ্গারা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠবে এটা স্বাভাবিক। তাদের ভিন্নপথে ব্যবহার করে ফায়দা লুটবার আমাদের তরিকাটাই বরং চরম অস্বাভাবিক।
বাংলাদেশকে যদি মানবাধিকার রক্ষাপ্রবণ একটি শান্তিপূর্ণ সভ্য দেশের কাতারে নাম লেখাতে হয়, তবে প্রতিবেশী হিসেবে আরাকান সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবার কোনো উপায় নেই। নিপীড়িত মানুষগুলোর প্রাণরক্ষার ব্যবস্থা করবার পাশাপাশি আমাদের বিশ্ব ফোরামে সমস্বরে সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানে আওয়াজ তুলতে হবে। আর বিশ্বের সব সহমর্মী ও সংবেদনশীল শান্তিকামী মানুষের উচিত হবে অং সান সু চিকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, আন্তর্জাতিক আইনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কীভাবে নির্যাতিত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। জগতের সবচেয়ে’ নির্যাতিত মানুষদের বাঁচানো, গণতন্ত্র বা মানবাধিকার রক্ষায় সু চি কি নিজে থেকে তাঁর ওপর অর্পিত শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের মর্যাদা রক্ষার দায়টুকু দেখাবেন?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন