স্বাধীন ভাবনা
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন একটি বিস্ময়
কোটি মানুষের আর্তনাদ, লাখো প্রাণের বলিদান, হাজারো মা-বোনের সংগ্রাম ও অজস্র মানুষের নিঃস্বার্থ ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। একাত্তরের সেই ভয়াবহ মুক্তিযুদ্ধের ফসল আজকের এই স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা বিশ্বদরবারে প্রমাণ করে দিয়েছে, বাংলার দামাল ছেলেদের বীরত্বগাথা ইতিহাসের কথা। স্বাধীনতার এই ৪৫ বছরে কী ভাবছে আজকের তরুণ সমাজ? তাঁদের প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশা কী, তা নিয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তাঁদের মতামত।
শাহ জামাল
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটি স্বপ্নের নাম। যে স্বপ্ন বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। যে চেতনা বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়, তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। আমার জন্ম হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দুই দশক পরে। একাত্তরের মহান যুদ্ধ আমার দেখা হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাবতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি গর্বিত এই জন্য যে, আমার কাছে একটি ইতিহাস, আমার অস্তিত্ব জুড়ে আছে বায়ান্ন, তেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তর।
বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। একদিন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে বর্তমান সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরই মধ্যে বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর কাছে বিস্ময়, এগিয়ে চলেছে দুর্বার। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।
সজীব আহমেদ
শিক্ষার্থী, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ
আমরা বর্তমান প্রজন্ম নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার জনগণের বীরত্ববোধ ও একাত্মবোধ বিশ্বদরবারে আজও একটি বিস্ময়। সেদিনের একাত্মবোধটাই, বিশেষ করে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু বড্ড আফসোস, আজ আমাদের মধ্যে সেই একাত্মবোধটা নেই। যে যার ইচ্ছেমতো স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসকে বিকৃত করে চলছে। মুক্তিযুদ্ধকে যতটা মূল্যায়ন করা দরকার, ততটা করছি না। মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের চেতনার রং, সে কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি বারবার। এ জন্য নতুন প্রজন্মের পাশে দাঁড়াতে হবে বিজ্ঞ অভিভাবকদের। আমাদের জানাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। আমরা যখনই মুরব্বিদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা কিংবা নির্যাতনের ইতিহাস শুনি, তখন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। তাই দেশ ও জাতিকে জাগ্রত করতে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার বিকল্প কিছু নেই। আজকে বিষয়টি তুচ্ছ ভাবলে আগামীতে বাঙালি নিঃস্ব হয়ে যাবে। তাই আসুন, নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরি।
কেশব চন্দ্র সরকার
শিক্ষার্থী, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার যুদ্ধ আমাদের দেশ-জাতির জন্য একটি গৌরবের বিষয়। কিন্তু আমাদের এ স্বাধীনতায় রয়েছে এক সুদীর্ঘ রক্তঝরা ও ত্যাগের ইতিহাস। আমাদের দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে নস্যাৎ করার জন্য পাক হানাদার বাহিনী মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এখন আমাদের দেশ বিশ্বের মানচিত্রে এক গর্বিত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে হবে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।
ফিরোজ আলী
শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাবনা, অদ্ভুত! এটা কি ভাবার বিষয় নাকি অনুধাবন করার? আমি যদি প্রতিদিন রুটিন করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাবি, তাতে হয়তো আমার বা দেশের তাৎক্ষণিক কোনো লাভ-ক্ষতি হবে না। কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আমরা যারা নতুন প্রজন্ম, এ জাতির পতাকাবাহী, দেশ গঠনের কাণ্ডারি, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও তাৎপর্যকে আলোকবর্তিকা করে স্বপ্ন বাস্তবায়নে এক পা না বাড়াই, তাহলে আমাদের পরের প্রজন্ম ভুল পথে পা দেবে—এটাই স্বাভাবিক। আমাদের শহীদরা ধিক্কার দেবেন, তাঁদের আত্মত্যাগ খুব সহজে পরিণত হবে আত্মগ্লানিতে। মনে রাখতে হবে, আমারা সুকান্তের সিঁড়ি, নজরুলের কাণ্ডারি। তাই ভয়ে পিছপা হওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। এ দেশ আমার। সুতরাং কেউ না থাকলেও, না এলেও, আমার নিজেকেই উঁচু করে রাখতে হবে দেশের লাল-সবুজের পতাকা। বুঝতে হবে, একশ শকুন তাড়ানোর জন্য একটা ঢিলই যথেষ্ট। কিন্তু এখন সময় ও সুযোগে কে সেই ঢিলটা ছুড়বে?
মোমিন মিরাজ
শিক্ষার্থী, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
‘মুক্তিযুদ্ধ’ শুধু একটি শব্দ নয়, একটি ইতিহাস, একটি গৌরবের পাতা। আমরা এ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে নিজ চোখে দেখিনি, তবে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারছি। মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে আমরা নতুন প্রজন্ম পেয়েছি স্বাধীনভাবে চলার অধিকার, বাকস্বাধীনতা, পেয়েছি পৃথিবীর বুকে নিজস্ব একটা ভূখণ্ড। তবে কষ্ট হয় এই ভেবে, আমরা তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হই প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি মহান যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিতে। যারা এই বিকৃতি করেছে বা করছে, আমরা নতুন প্রজন্ম কোনো দিন তাদের ক্ষমা করব না। যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দিয়েছে একটি স্বাধীন দেশ, যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাঁধে তুলে দিয়েছে দেশ গড়ার দায়িত্ব, ওই মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমরা কখনো ভুলব না। সব বিভেদ ভুলে গড়ে তুলি এক স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ, যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমাদের বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে দেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।