রোহিঙ্গা সংকট
নাফ নদে মুখ থুবড়ে পড়েছে মানবতা
নাফ নদের ওপারে মিয়ানমার অংশে কাদা-বালুতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এক মানব শিশুর লাশ। একটি-দুটি নয়, বেশ কয়েকটি। তাদের পরিচয় বলা হচ্ছে, তারা রোহিঙ্গা শিশু। অথচ তাদের জন্মপরিচয় ছিল মানুষ হিসেবেই। আমি বারবার করে চাইছিলাম, ছবিগুলো যেন বরাবরের মতো ফটোশপের কারসাজি হয়। কিন্তু এগুলো তা হওয়ার নয়, এতটা স্পষ্ট আর নির্মম ছবিগুলো যে দ্বিতীয়বার আর চোখ রাখা যায় না সেদিকে।
দুই-তিন সেকেন্ডে যা দেখলাম, একটি শিশুর চোখেমুখে ঢুকে গেছে কাদা-মাটি আর বালু। এর পর সেই ছবির দিকে তাকানোর মতো দুঃসাহস আর হলো না। এ রকম বেশ কয়েকটি ছবি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের নিউজফিড জুড়ে।
মর্মান্তিক ছবিগুলো দেখে সাগরতীরে নিথর ও উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির লাশটির কথা মনে পড়ল। নিষ্পাপ আয়লানের সেই ছবি দেখে কয়েক দিন ফেসবুকে বসাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি ভেবে পাই না, কীভাবে এই সভ্য যুগেও মানুষদের একটি পক্ষ আরেকটি পক্ষকে এভাবে জাতিগতভাবে নির্মূল করতে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদেরও হত্যা করতে পারে? আর এ অবস্থায় কীভাবে সে দেশেরেই একজন নোবেলজয়ী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী সুনসান নীরব থাকতে পারেন?
আমার বোধে আসে না।
মিয়ানমারের পশ্চিমা প্রদেশ আরাকান (রাখাইন) বরাবরই জ্বলছে। আবার জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে। আরাকান রাজ্যের পুরোনো রাজধানীসহ পুরো রাজ্যে চলছে বৌদ্ধ রাখাইনদের সশস্ত্র মিছিল। মিছিল চলছে পিপগাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশা, টুকটুক কিংবা সাইকেলে চড়ে—কিন্তু সবচেয়ে বেশি লোক চলছে হেঁটেই। তাদের সঙ্গে আছে বর্শা, তরবারি, ধামা, বাঁশ, গুলতি, তীর-ধনুক এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে পেট্রলবোমাও। দলে দলে সশস্ত্র লোকজন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা করছে। এরা তাদের দেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাত করতে চায়। স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় রাখাইন উগ্র বৌদ্ধরা পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার থেকে বের করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে গণহত্যার উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন নাফ নদের পাড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে নারী-শিশুদের লাশের সারি।
মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে করা জঘন্য অপরাধগুলো লুকিয়ে রাখতে চায়, সে জন্য তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়া, এনজিও, সাহায্য সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘকেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রবেশাধিকার দেয় না—পাছে তারা বর্বরতার মাত্রা বুঝে ফেলে। আর যেহেতু রোহিঙ্গাদের সার্বিক নির্মূল রাষ্ট্রীয় নীতিরই অংশ, তাই মুসলিম ভুক্তভোগীদের জন্য মিয়ানমারের সরকারি সংস্থাগুলো থেকে কোনো সাহায্যই পৌঁছে না। আরো জঘন্য বিষয় হচ্ছে এই যে, ওআইসি কিংবা ইসলামিক রিলিফ থেকে পাঠানো ত্রাণসামগ্রীও প্রাপক রোহিঙ্গা ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছেনি কোনোকালে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে ত্রাণ কার্যালয়ও খুলতে দেয় না তারা।
অনেককাল ধরেই চীন, ভারতসহ অন্যান্য এশীয় ও প্রশান্ত অঞ্চলের দেশগুলো মিয়ানমারের নির্দয় সামরিক সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। এখানে মানবাধিকার কখনো অগ্রাধিকার পায়নি। অনেক দিন ধরেই ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো মিয়ানমারে ব্যবসা করতে পারেনি। তাদের অংশগ্রহণের জন্য মিয়ানমারের পরিচায়ক মুখের পরিবর্তন ছিল অপরিহার্য। এই বিকৃত পদ্ধতি শুরু হয় যোগ্যতাহীন সু চিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে—আর তার ধারাবাহিকতায় আসে সেনাসদস্যদের অসামরিক পোশাক পরে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে পরিচিতি দেওয়ার নাটকের দৃশ্যায়নে। ওটা যেন ছিল বার্মার গর্বাচেভীয় গ্লাসনস্ত মুহূর্ত—যখন বার্মার নাম পাল্টে মিয়ানমার রাখা হয়। এই দাবির ধারাবাহিকতায় আসে ২০১০ সালের নির্বাচন ও এর পরের উপনির্বাচন, যেখানে সু চির এনএলডি পার্টি সদ্যোমে অংশ নেয়—উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে, মিয়ানমার ফ্যাসিবাদী সামরিক গোষ্ঠীশাসন থেকে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রে উত্তীর্ণ হচ্ছে। এর পরে আসে থেইন সেইনের অলিখিত দূত হিসেবে সু চির পশ্চিমা বিশ্ব সফর, যেখানে তিনি বার্মার সঙ্গে বহির্বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য পুনঃস্থাপনের অনুরোধ জানান। এখন সু চি পশ্চিমা শক্তির সমর্থন নিয়ে জান্তাদের পরোক্ষ শক্তিদেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে।
রোহিঙ্গাদের নির্মূল করা এখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় এক প্রকল্পে পরিণত হয়েছে, যেখানে তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতীক অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের অধিকাংশ বৌদ্ধ কোনো না কোনোভাবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী। অনেকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও হন্তারক রাখাইন বৌদ্ধ ও সরকারের গণহত্যার প্রকল্পের ব্যাপারে রহস্যজনক নীরবতা কিংবা মৌন সম্মতি দিয়ে চলেছে। রাখাইন বৌদ্ধরা এখন তাদের নিজস্ব ধাঁচের নির্মূল প্রচেষ্টার স্টাইল খুঁজে পেয়েছে। তারা ১৯৩৮ সালের নাৎসি পার্টির ধারাবাহিক নির্যাতন, হত্যা ও লুণ্ঠনকে অনুকরণ করছে, যখন একের পর এক ইহুদি লোকালয় আক্রমণ করা হয়েছিল। এই হারে চলতে থাকলে নিজ মাতৃভূমি আরাকানেই মুসলিমদের কোনো চিহ্ন ভবিষ্যতে অবশিষ্ট থাকবে না।
বিশ্বের নির্যাতিত যেসব জাতিগোষ্ঠী আছে, তাদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। কসোভোতে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আশ্রয়স্থান আছে। এমনকি ফিলিস্তিনিদেরও রয়েছে ন্যূনতম আশ্রয়। কিন্তু এ মুহূর্তে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সেটিও নেই। নিজ দেশে তারা পরবাসী।
আর কত রোহিঙ্গার মৃত্যু, ঘরবাড়ি ধ্বংস, নারী ধর্ষিত হলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো সাম্প্রতিক এই ভয়ানক বর্ণবাদী নৃশংসতা রোধে এগিয়ে আসবে? বর্ণবাদী প্রতিহিংসা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সন্ত্রাস ও নৃশংসতা এবং সেইসঙ্গে ঔদ্ধত্য ও শক্তির নিষ্ঠুরতার ইঙ্গিতবাহী এই পরিকল্পিত ও বিধ্বংসী অপরাধকে আর কত দিন বিশ্বমানবতা সয়ে যাবে?
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলদেশ প্রতিদিন।