প্রবাসের পত্র
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীদের ভাষাশহীদ স্মরণ
ক্যালেন্ডারের পাতায় ফেব্রুয়ারি মাস বা ২১ তারিখটি আলাদাভাবে চিহ্নিত না থাকলেও বাঙালি কিংবা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে এর তাৎপর্য বিশেষ। আগুন ঝরা দ্রোহ আর বাঙালি সত্তার জাগরণের দিন এই ২১ ফেব্রুয়ারি। আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এক দিন।
কালের বিবর্তনে এখন গোটা ফেব্রুয়ারিই যেন বাংলা ভাষার মাস। আত্মমর্যাদা বিকাশের স্মারক।
বাঙালির দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপ অভিযানের মতোই ১৯৬২ সালে অস্ট্রেলিয়া অভিযানের শুরু। পর্যায়ক্রমে অভিবাসীদের সংখ্যার বৃদ্ধিতে প্রতিভাবানদের সারিও প্রসারিত হয়েছে। তাঁরা জানতেন, একটি জাতির ভাষার বিকাশ ঘটে চর্চা ও ব্যবহারের মাধ্যমে। এরই অংশ হিসেবে শুরুতে বৈঠককক্ষে দেশি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তার পরিসর বড় হয়। বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন নিয়ে ভাবনারও শুরু হয়।
একুশকে বৈশ্বিক রূপ দিতে নির্মল পালসহ কয়েকজন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশির প্রচেষ্টায় ২০০৪ সালে গঠিত হয় একুশে পরিষদ। এর পরবর্তিত নাম ‘একুশে একাডেমি’।
২০০৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে বাঙালির ভাষাগত মর্যাদা ও মননের প্রতীক শহীদ মিনার নির্মিত হয় সিডনিতে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অ্যাশফিল্ড হেরিটেজ পার্কে শহীদ মিনারটির নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তহবিল থেকে প্রাপ্ত অনুদান ও স্থানীয় বাংলাদেশিদের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত এই সৌধ আজ প্রশান্ত পারের সাথে বঙ্গোপসাগরের সম্প্রীতির বিনি সুতার মালা!
প্রতি বছরের মতো এবারও অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অ্যাশফিল্ড হেরিটেজ পার্কে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বইমেলা। বৃষ্টিস্নাত হেরিটেজ পার্ক সেদিন ‘এসো বাংলার মাটির ভাষার ছেলেরা আজকে, সেই ফাল্গুন এসেছে আবার ফেব্রুয়ারির সেই রাজপথ ক্ষুব্ধ নীরব-বাতাস ব্ন্য, আজকে মিছিল হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার জন্য’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বাংলাদেশিরা।
এ আয়োজনে অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় মেয়র, এমপি, কাউন্সিলরসহ লেবার ও লিবারেল পার্টির নেতা-কর্মীরা। প্রায় ২০ হাজার প্রবাসী ও ভিনদেশি ভাষার লোকজনের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
পুস্পস্তবক অর্পণ, প্রভাতফেরি ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান চলে। বইমেলা সেজেছিল দুই বাংলার কীর্তিমান লেখকদের বই দিয়ে। দেশের নামিদামি থেকে শুরু করে নবীন লেখকদের অনেক বই-ই আকৃষ্ট করেছে পাঠকের হৃদয়। এ ছাড়া একুশের গান, কবিতা আবৃত্তি, দলীয় সংগীত, একক সংগীত, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানসহ স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিও ছিল।
অনুষ্ঠানে আগত শিশুদের জন্য পৃথক বিনোদনের ব্যবস্থা হিসেবে ছিল জাম্পিং ক্যাসেল। ছিল রকমারি মুখরোচক খাবারের দোকান। সবাই নিজ উদ্যোগে শখের বশে পসরা নিয়ে বসেছিল। তবে দিন শেষে লাভের অংশটাও কম নয়।
বিকেলে একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়ার আয়োজনে সেলিম আল দীনের ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এটি নির্দেশনায় ছিলেন সিডনিপ্রবাসী জনপ্রিয় অভিনেতা শাহিন শাহনেওয়াজ। নাটকটির মঞ্চায়ন প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে সংস্কৃতিখরায় বিপুলা জলরাশি হয়ে এসেছিল।
রক্তরাঙা ফাল্গুনের আগুনমাখা দিন মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। শোক ও শ্রদ্ধায় অবনত বাঙালির অবিস্মরণীয় সংগ্রামের দিন। এ দিনই প্রথম খুলেছিল বাঙালির কালজয়ী সব সংগ্রামের উৎসমুখ। এ দিনটিই বাঙালিকে নতুন করে বেঁধেছে হাজার বছরের ঐতিহ্য সংস্কৃতির বন্ধনে।
মহান একুশ মাতৃভাষাকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের ছয় হাজার ৩১০টি ভাষার মানুষ নিজ নিজ ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। বিশ্বময় উদযাপিত হয় পরম শ্রদ্ধায়।
সিডনি (অস্ট্রেলিয়া) থেকে