সালতামামি ২০১৬
আন্তর্জাতিক ফুটবলে অঘটনের বছর
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে ছিল অঘটনের ছড়াছড়ি। এক বছরে এত এত অঘটন খুব কমই দেখা গেছে ফুটবল বিশ্বে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিচের সারির ক্লাব লিস্টার সিটির শিরোপা জয়, প্রথমবারের মতো ইউরো কাপে অংশ নিয়েই আইসল্যান্ডের কোয়ার্টার ফাইনাল আর ওয়েলসের সেমিফাইনালে চলে যাওয়া, সবশেষে পর্তুগালের প্রথম শিরোপা জয়। সবই ছিল বড়সড় অঘটন। শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত কোপা আমেরিকার বিশেষ সংস্করণে আর্জেন্টিনার শিরোপা না জিততে পারাটাও ছিল অপ্রত্যাশিত। সেই হারের হতাশা থেকে লিওনেল মেসির অবসরের সিদ্ধান্ত, আবার আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরা- এগুলো নিয়েও বেশ সরগরম ছিল ২০১৬ সাল। বছর শেষে দেখে নেওয়া যাক ফুটবলের আলোচিত ঘটনাগুলো।
লিস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা
১০ বছর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির লিগে খেলার পর ২০১৪ সালে প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পেয়েছিল লিস্টার সিটি। ২০১৪-১৫ মৌসুমটি শেষ করেছিল ১৪তম অবস্থান নিয়ে। সেই দলটি যে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিততে পারবে, এমনটা কারো কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু একের পর এক জয় দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন লিস্টার সিটির ফুটবলাররা। মৌসুমের মাঝামাঝি পর্যায়ে লিস্টারকে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে দেখে অনেকে বলতে শুরু করেছিলেন তাদের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনার কথা। কিন্তু তখনও সেটা বিশ্বাস করতে রাজি ছিলেন না অনেকে। ক্লাবটির সাবেক তারকা গ্যারি লিনেকার তো বলেই বসেছিলেন যে, লিস্টার শিরোপা জিতলে তিনি নগ্ন হয়ে বিবিসির অনুষ্ঠানে আসবেন।
কিন্তু মৌসুমের শেষে সত্যিই সবাইকে অবাক করে দিয়ে লিস্টার জিতে নিয়েছিল প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। কথা রেখেছিলেন লিনেকারও। বিবিসির ফুটবল বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’-তে শুধু একটা হাফপ্যান্ট পরে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক এই তারকা।
আইসল্যান্ড আর ওয়েলসের চমক
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লিস্টার সিটির মতো চমক দেখিয়েছে আইসল্যান্ড। প্রথমবারের মতো ইউরো কাপে খেলতে এসেই ছোট্ট এই দেশটি চলে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। শেষ ষোলোর লড়াইয়ে তারা হারিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে শেষ হয়েছিল আইসল্যান্ডের স্বপ্নযাত্রা।
ইউরো কাপে চমক দেখিয়েছে ওয়েলসও। তারাও ইউরোপসেরার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল প্রথমবারের মতো। অভিষেক টুর্নামেন্টেই চলে গিয়েছিল সেমিফাইনাল পর্যন্ত। অধিনায়ক গ্যারেথ বেলের দুর্দান্ত নৈপুণ্যে নকআউট পর্বে তারা হারিয়েছিল নর্দান আয়ারল্যান্ড ও বেলজিয়ামকে। সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে অবশ্য আর পেরে ওঠেনি ওয়েলস। হেরে গিয়েছিল ২-০ গোলে।
ওয়েলসকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পর প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের স্বাদও পেয়েছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। দলটির অধিনায়ক এ সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার হলেও পর্তুগাল যে ফ্রান্স-জার্মানি-ইতালির মতো শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে লড়াই করে শিরোপা জিতে ফেলবে, তা অনেকে কল্পনাও করতে পারেননি। গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচের এতটিতেও জয় পায়নি পর্তুগাল। তিনটিতেই ড্র করে কোনোমতে জায়গা করে নিয়েছিল নকআউট পর্বে। এরপর একে একে ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড ও ওয়েলসকে হারিয়ে চলে এসেছিল ফাইনালে। শিরোপা জয়ের অন্তিম লড়াইয়ে ২৫ মিনিটের মাথায় চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়েছিল রোনালদোকে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে শেষপর্যন্ত শিরোপা জিতে নিয়েছিল পর্তুগাল। স্বাগতিক ফ্রান্সকে হারিয়েছিল ১-০ গোলে।
আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গ, মেসির কান্না
ক্লাব ফুটবলে একের পর এক শিরোপা জিতে চললেও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে কোনো সাফল্য না পাওয়ার হতাশাটা মেসির চিরদিনের। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ও ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালে গিয়েও হতাশ হতে হয়েছিল আর্জেন্টাইন এই তারকাকে। শিরোপা জয়ের অন্তিম লড়াইয়ে আর জিততে পারেননি। এ বছর কোপা আমেরিকার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা সেই হতাশা ঘোঁচাতে পারবে, এমন আশাই করেছিলেন অনেকে। দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে ফাইনাল পর্যন্তও চলে গিয়েছিল মেসির দল। প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছিল চিলিকে। ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনালে এই চিলির কাছে হেরেই শেষ হয়েছিল আর্জেন্টিনার শিরোপা স্বপ্ন। এবার প্রতিশোধ নিয়ে শিরোপা জয়ের উল্লাসে মেতে ওঠার সব আয়োজনই সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা।
কিন্তু ফাইনালে আবারও হতাশ হতে হয় আর্জেন্টিনাকে। টাইব্রেকারে পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন পাঁচবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার মেসি। ম্যাচ শেষে কান্নায় ভেঙে পড়েন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। ক্ষোভ-হতাশা থেকে হুট করে বিদায়ই বলে দেন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে। পরে অবশ্য অনেকের অনুরোধ-অনুনয়ের পর সেই কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন মেসি। আবার ফিরেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে। কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে বড় কোনো শিরোপা জিততে না পারার হতাশাটা মেসি এ বছরও ঘোচাতে পারেননি।
চ্যাপেকোয়েন্স ট্র্যাজেডি
ফুটবল বিশ্বের জন্য ২০১৬ সালের শেষটা হয়েছে মন খারাপ করে দেওয়ার মতো এক ট্র্যাজেডি দিয়ে। ভয়াবহ এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ব্রাজিলের ক্লাব চ্যাপেকোয়েন্সের বেশ কয়েকজন ফুটবলার। কোপা সুদামেরিকানার ফাইনাল ম্যাচ খেলার জন্য কলম্বিয়া যাওয়ার পথে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। প্রাণ হারান ৭১ জন। এর মধ্যে অনেকেই ছিলেন চ্যাপেকোয়েন্সের ফুটবলার ও কর্মকর্তা।
শেষপর্যন্ত আর খেলাও হয়নি ফাইনাল ম্যাচটি। বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে চ্যাপেকোয়েন্সকেই।