জুভেন্টাসের ফুটবল-রূপকথা
বার্লিন, ২০০৬। ইতালির অধিনায়ক ফাবিও ক্যানাভারো মাথার ওপরে তুলে ধরলেন বিশ্বকাপ শিরোপা। তখনো কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে ইতালিয়ান ফুটবল আর জুভেন্টাসের জন্য। ইতালির ঘরোয়া ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে শিকড় গেঁথেছিল পাতানো খেলার বিষবৃক্ষ। জার্মানি বিশ্বকাপ শুরু হওয়া আগে থেকে শুরু হয়েছিল সেই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার অভিযান। আর বিশ্বকাপ শেষে ‘থলের বিড়াল’ বেরিয়ে পড়ার প্রভাবে টলে উঠেছিল পুরো ইতালিয়ান ফুটবলাঙ্গন।
পাতানো খেলার ‘ঝড়ে’র সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছিল জুভেন্টাস। ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে নেমে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিভাগে। কিন্তু জুভেন্টাস আবার সেই বার্লিনে ফিরেছে দাপটের সঙ্গে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারাতে পারলে প্রথমবারের মতো ট্রেবল জয়ের আনন্দে মেতে উঠতে পারবে ইতালিয়ান লিগের সফলতম ক্লাবটি।
ট্রফি জয়ের হিসাবে জুভেন্টাসের ধারে-কাছেও ইতালির কোনো ক্লাব নেই। ভক্তরা আদর করে প্রিয় ক্লাবের নাম দিয়েছে ‘ওল্ড লেডি অব তুরিন’। তবে ভক্তরা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি ‘তুরিনের বৃদ্ধা’র শরীরে অগোচরে বাসা বেঁধেছে পাতানো খেলা আর অন্যায় সুবিধা নেওয়ার ‘ক্যান্সার’! ২০০৬ সালে ইতালিয়ান ফুটবল এজেন্সির এক তদন্তে বেরিয়ে আসে, জুভেন্টাসসহ সেরি আ ও সেরি বির কয়েকটি দল পাতানো খেলা এবং রেফারিদের অ্যাসোসিয়েশনের যোগসাজসে নানা রকম অবৈধ সুবিধা ভোগের সাথে জড়িত।
জুভেন্টাসের তৎকালীন দুই ব্যবস্থাপক লুচানো মজ্জি ও আন্তনিও জিরাউদোর সঙ্গে রেফারিদের অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন কর্মকর্তার গোপন ফোনালাপে প্রথম ধরা পড়ে বিষয়টি। জুভেন্টাস সে সময় ছিল টানা দুইবারের সেরি আ চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু দুর্নীতির কবল থেকে ইতালিয়ান ফুটবলকে রক্ষা করতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হয়নি দেশটির ফুটবল ফেডারেশন। জুভেন্টাসের ২০০৪-২০০৫ ও ২০০৫-২০০৬ মৌসুমের শিরোপাই শুধু কেড়ে নেওয়া হয়নি, তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেরি বিতেও। শাস্তি এতটাই কড়া ছিল যে পরের মৌসুমের সেরি বি শুরু হওয়ার আগে তাদের বেশ কিছু পয়েন্টও কেটে রাখা হয়েছিল। নিষিদ্ধ হয়েছিল ২০০৬-০৭ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে। আর্থিক জরিমানা তো করা হয়েছিলই।
২০০৬-০৭ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগে খেলতে বাধ্য হয় জুভেন্টাস। তত দিনে দল থেকে বিদায় নিয়েছেন লিলিয়ান থুরাম, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, ফাবিও ক্যানাভারোর মতো তারকারা। কিন্তু এই চরম পেশাদারত্বের যুগেও ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে খেলতে রাজি হয়ে যান জানলুইজি বুফন, আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো, পাভেল নেদভেদরা।
শুরু হয় ‘ওল্ড লেডির’ সম্মান পুনরুদ্ধারের লড়াই। সে মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেরি আতে ফিরে আসে জুভেন্টাস। ইতালির সেরা লিগে পরের মৌসুমে তৃতীয় হয়ে আবার ফিরে পায় চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার সুযোগ। কিন্তু পুরনো ছন্দে যেন কিছুতেই ফিরতে পারছিল না ‘জুভ’। নানা ভাঙ্গা-গড়ার পরও আসছিল না কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। ২০০৯-২০১০ মৌসুমে তারা ইতালিয়ান লিগ শেষ করে সপ্তম দল হিসেবে। ২০১১ সালে জুভেন্টাসের সাবেক খেলোয়াড় আন্তনিও কন্তের হাতে তুলে দেওয়া হয় কোচের দায়িত্ব। তার পরই ধীরে-ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ‘তুরিনের বৃদ্ধা’।
২০১১-১২ মৌসুমে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই শুরু, তারপর টানা চার মৌসুমে সেরি আর শিরোপা গেছে ‘জুভ’দের ঘরে। ইতালিয়ান লিগের রেকর্ড ৩১তম শিরোপা জিতেছে এবারের মৌসুমে। ইতালিয়ান কাপের শিরোপাও উঠেছে জুভেন্টাসের ট্রফি কেসে। শনিবার রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারাতে পারলে ট্রেবল-উৎসবেও মেতে উঠবে জুভেন্টাস-ভক্তরা।
বার্লিনে ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে ইতালিয়ানদের হাতে ফুটবলের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ট্রফি শোভা পাওয়ার সময় বোঝা যায়নি সামনে কী মারাত্মক দুঃসময় অপেক্ষা করছে জুভেন্টাসের জন্য। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসা তুরিনের ‘ওল্ড লেডি’র সেই কলঙ্ক হয়তো আজ স্মৃতিতে ধূসর। তবে ফিনিক্স পাখির মতো জুভেন্টাসের এই পুনরুত্থানকে কুর্নিশ না করে উপায় নেই!