সাক্ষাৎকার
রুবেলের আক্ষেপ, রুবেলের অতৃপ্তি
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপের দেশে পা রাখা বাংলাদেশ নিজেদের ব্যর্থতার কাছে হেরে ফিরেছে শূন্য হাতে। বিশ্বকাপে মাশরাফি-সাইফউদ্দিনদের বল ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য দারুণ উপহার। যেখানে মিচেল স্টার্ক, জোফরা আর্চার, লকি ফার্গুসনরা গতি ও সুইং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের ঘাম ঝরিয়েছেন। মোহাম্মদ আমির নানা বৈচিত্র্যে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করেছেন। সেখানে টাইগারদের গতি-বৈচিত্র্যহীন বোলিং বেশ হতাশ করে তুলেছে টাইগার ভক্তদের। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায় বিশ্বকাপে কতটা ব্যর্থ ছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। দলের সদস্য রুবেল হোসেনের চোখেও বিশ্বকাপে বোলারদের ব্যর্থতা প্রকট।
দেশে ফিরে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রুবেল বলেন, ‘আমরা বোলাররা যদি ব্যাটসম্যানদের আরেকটু সাহায্য করতে পারতাম, তাহলে ফলাফলটা অন্য রকম হতে পারত।’
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা অর্জনের সঙ্গে আপনার নাম জড়িয়ে; কিন্তু এবার সুযোগের অভাবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি, এটা কত কষ্ট দেয়?
এটা অবশ্যই কষ্টদায়ক। কারণ, প্রতিটি মানুষই বিশ্বকাপে যায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। তেমন আমারও স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে খেলা, ভালো করা। ভালো করলে সবাই খুশি হতো, এ দেশের মানুষ ক্রিকেটকে অনেক ভালোবাসে, তাই খেলতে পারলে নিজের কাছেই অনেক ভালো লাগত। আর বিশ্বকাপ বিষয়টা অন্যরকম। কারণ, অন্য সিরিজগুলো সবাই দেখে না, কিন্তু বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট একসঙ্গে সবাই খেয়াল রাখে। এখানে পারফর্ম করা বিশেষ কিছু। দলের ভারসাম্যের জন্য যেহেতু খেলানো হয়নি, সেখানে আসলে কিছু বলার থাকে না। যে দুইটা ম্যাচে সুযোগ পেলাম, সেটা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলাম না। একটা ম্যাচ ভালো হয়নি। যদি আরও কয়েকটা ম্যাচ খেলতে পারতাম, হয়তো নিজের কাছে ভালো লাগত। নিজেকে প্রমাণ করার আরও একটু সুযোগ পেতাম।
বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে আপনার গতি মোটামুটি বেশি, অভিজ্ঞতাও ছিল। আপনার কি মনে হয়নি, আপনি আরো সুযোগ পেতে পারতেন?
আসলে এটা আমার মনে হয় না। কারণ, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচকরা আমায় রাখেনি, এখানে আমার চাওয়া-পাওয়াতেও কিছু নেই। আবার এত পেসার নিয়ে তো আর খেলা যায় না। সাইফউদ্দিনও ভালো করেছে, মুস্তাফিজও ভালো করেছে। আর মাশরাফি ভাই ছিলেন, তাই আমার সুযোগ হয়নি। আর সব ম্যাচে চারজনকে তো খেলানো যায় না। কিছু কিছু ম্যাচে নির্বাচকদের প্রয়োজন মনে হয়নি। যদি সুযোগ পেতাম, আমার জন্য ভালো হতো। নিজেকে আরেকটু ভালো করার সুযোগ পেতাম।
দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে আপনার মধ্যে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে কি না?
আসলে এ ধরনের মঞ্চে আপনার ভালো খেলার বিকল্প নেই। আপনি যখন একটা সুযোগ পান, সেটা ভালোভাবে কাজে না লাগাতে পারলে পরে সুযোগ পাওয়া খুব কঠিন। এটা একটা মানসিক চাপ। তার মধ্যে বড় মঞ্চে খেললেও কিছুটা চাপ কাজ করে। যদিও আমার মধ্যে তেমন অনুভব হয়নি, মনে হয়েছে আর দু-একটা সুযোগ পেলে আমিও ভালো করতে পারতাম। অথবা যেই দুইটায় সুযোগ পেলাম, তাও যদি পরপর পেতাম তাহলেও মনে হয় ভালো করতে পারতাম। আমার প্রথম ম্যাচটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, তারপর আবার বিরতি দিয়ে ভারতের বিপক্ষে। তো, এই বিরতিটা আমার জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে দিয়েছে। পরপর দুই বা তিনটা ম্যাচ যদি খেলতে পারতাম, আমার মধ্যে চাপটা কম থাকত। তখন একটা না একটা ম্যাচ দিয়ে ফর্মে ফিরতেই পারতাম। এই ধরুন সাইফউদ্দিনরা প্রতিটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে। তারা ভালোও করেছে, আবার খারাপও করেছে। এটা প্রতিটি ক্রিকেটারের জন্যই। খেলার মধ্যে থাকলে ভালো পারফরম্যান্স অবশ্যই বের হয়ে আসে। একজন ক্রিকেটার প্রতিটি ম্যাচেই কিন্তু খারাপ খেলতে পারে না। খেলার মধ্যে থাকলে ভালো-খারাপ সবই হবে। আমিও যদি একটা ম্যাচ ভালো করতে পারতাম, তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যেত।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ফল নিয়ে আপনার ব্যক্তিগতভাবে কতটা আক্ষেপ হচ্ছে?
অবশ্যই খারাপ লাগে। কারণ, আমরা সবাই সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিলাম। এটা খুবই আক্ষেপের। দল হিসেবে সেই পারফর্ম করতে পারিনি। অনেকটা ভাগ্যও সহায় ছিল না। দু-একটা ম্যাচ খুব কাছে গিয়েও খেলেছি, আবার একটা ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। এটা খুব কষ্টকর। আমরা সেমিফাইনাল খেলার মতো দল ছিলাম। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ না হওয়াটা খুব আক্ষেপের।
এই ব্যর্থতার পেছনে কী কী ত্রুটি দেখছেন?
সত্যি কথা বলতে, একটা বিশ্বকাপে ব্যাটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে হিসেবে আমাদের ব্যাটিংটা বিশ্বকাপে খুব ভালো হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের বোলিংটা আরেকটু ভালো হলে ভালো কিছু হতে পারত। বোলাররা আমরা যাঁরা খেলেছি, তাঁরা যদি ব্যাটসম্যানদের আরো সাপোর্ট দিতে পারতাম, তাহলে ব্যাটসম্যানদের জন্য লড়াই করা আরো সহজ হতো। আপনি দেখবেন, বিশ্বকাপে প্রায় অনেক ম্যাচেই তিনশর অধিক রান করেছি। ব্যাটসম্যানরা দু-একটা ছাড়া সবম্যাচেই অসাধারণ ছিল।
ফিল্ডিংয়ের ভুলগুলো নিয়ে কী বলবেন?
আসলে ফিল্ডিংয়ে টুকটাক ভুল সবারই হয়। বিশেষ করে ক্যাচ মিস। একজন খেলোয়াড় তো আর ইচ্ছে করে মিস করে না। তামিমের ভাইয়ের ওপর অনেকের রাগ, যে তামিম ভাই ক্যাচ মিস করেছেন। কিন্তু এত বড় মঞ্চে তিনি তো আর ইচ্ছে করে ক্যাচ মিস করেননি। এটা উনি কেন, কোনো খেলোয়াড়ই করে না। একজন ক্রিকেটার যখন মাঠে নামে, তখন নিজের সেটা দিয়ে দলের জন্য খেলার চেষ্টা করে। এটা যে কেউ করতে পারত। তামিম ভাই ক্যাচটা মিস করার পর উনার কতটা খারাপ লাগছে, সেটা উনিই ভালো জানেন। আমাদের ফিল্ডিংটা আরো একটু ভালো হতে পারত। আমরা চেষ্টা করেছি, হয়তো ভাগ্য সঙ্গে ছিল না।
সাকিবের পারফরম্যান্সকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এই বিশ্বকাপে সাকিব ভাইয়ার অসাধারণ একটা টুর্নামেন্ট কেটেছে। আমার ১০ বছরে ক্যারিয়ারে সাকিব ভাইয়ার এমন ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আমি কখনো দেখিনি। পুরো টুর্নামেন্টে তিনি রাজত্ব করেছেন। মনে হয়েছে, ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। সাকিব ভাই দেখিয়েছিন, কীভাবে ভালো পজিশনে থেকে দলের দায়িত্ব নেওয়া যায়, কীভাবে ভালো পজিশনে থেকে দায়িত্ব নেওয়া যায়। সে খুবই ধারাবাহিক ছিল, আমরা সবাই যদি তাঁকে ঠিকঠাক সমর্থন দিতে পারতাম, তাহলে আমাদের ফল অন্যরকম হতে পারত। আমার চোখে এই বিশ্বকাপে সাকিব ভাই ছিলেন অসাধারণ।
বিশ্বকাপ থেকে নিজের ব্যক্তিগত কী শিক্ষা নিলেন?
যদিও আমি মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেছি, তারপরও আমি পুরো টুর্নামেন্টে দলের সঙ্গে ছিলাম। দলের খারাপ-ভালো সময় থেকে অনেক কিছু শিখেছি। কীভাবে চাপের মুহূর্তে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়, তাও দেখেছি। এমন বড় টুর্নামেন্টে আমাদের বোলারদের ওপর অনেক দায়িত্ব থাকে, সেই দায়িত্বগুলো অনুভব করার চেষ্টা করেছি। এটা আমি সামনের দিকে আশা করি, কাজে লাগাতে পারব।
সামনে শ্রীলংকা সফর, তার আগে বিশ্বকাপের ব্যর্থতার ক্ষত কতটা কাটবে?
দেশে ফেরার পর আমরা এখনো অনুশীলন শুরু করিনি। নিজেও পুরোপুরি ফিট নেই। ভারতের বিপক্ষে ফিল্ডিং করার সময় ব্যথা পেয়েছিলাম। ব্যাকপেইনের সেই সমস্যাটা এখনো আছে। ওইটা সুস্থ করার চেষ্টা করছি। ডাক্তার দেখালাম। আশা করি দু-একদিনের মধ্যেই অনুশীলনে ফিরব। আর বাকিরাও সব কাটিয়ে ভালো একটা সফর করবে বলে আশা করি।
এক বছর বাদেই টি২০ বিশ্বকাপ, এর মধ্যে সব শুধরে নতুন দল হিসেবে সুযোগ করে নেওয়া কতটা চ্যালেঞ্জিং?
অবশ্যই এটা চ্যালেঞ্জিং। আমার ব্যক্তিগতভাবে বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এই বিশ্বকাপে খুব একটা খেলতে পারিনি। যেই দুইটা ম্যাচে সুযোগ এলো, সেটাও কাজে লাগাতে পারিনি। এখন নতুনভাবে শুরু করতে হবে। তবে দলের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে না। কারণ, যারা এই বিশ্বকাপ খেলেছে। ঘুরেফিরে তারাই আগামী বিশ্বকাপে থাকবে। দু-একজন এদিক-সেদিক হলেও তেমন পরিবর্তন আসবে না। তাই মনে হয় না তার মধ্যে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়াটা কঠিন হবে।