আজও আতঙ্কে সেদিনের ‘হিরো’
২০০৯ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম হয়েছিল ক্রিকেট-ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কিত অধ্যায়ের। সেদিন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দল ও আম্পায়ারদের বহন করা বাসে সন্ত্রাসী হামলায় নিরাপত্তারক্ষী ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে মারা গিয়েছিল আটজন। গুরুতর আহত হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার সাত ক্রিকেটার ও আম্পায়ার আহসান রাজা। এর পর পাকিস্তানের মাটিতে ‘ব্রাত্য’ হয়ে পড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দীর্ঘ ছয় বছর পর ফিরতে যাচ্ছে জিম্বাবুয়ের হাত ধরে। কিন্তু সেদিনের ভয়াবহ ঘটনা আজো ভুলতে পারেননি বাসচালক মেহের খলিল। সেই বিভীষিকা এখনো তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে।
দীর্ঘ ছয় বছর পর দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখার সুযোগ পাচ্ছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীরা। শুক্রবার রাতে পাকিস্তান-জিম্বাবুয়ে প্রথম টি-টোয়েন্টি শুরু হওয়ার আগে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে সম্মাননা দেওয়া হবে খলিলকে।
লাহোর টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা শুরু হওয়ার ঠিক আগে খলিলের অবিশ্বাস্য সাহসিকতা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছিল। হোটেল থেকে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের অবিরাম গুলি-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাস চালিয়ে নিয়ে যান তিনি। স্টেডিয়াম থেকে বিশেষ হেলিকপ্টারে বিমানবন্দর এবং সেখান থেকে দেশে ফেরার ফ্লাইট ধরেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা।
ক্রিকেটারদের জীবন বাঁচিয়ে দেওয়া খলিলকে পরে পুরস্কৃত করেছিল শ্রীলঙ্কা সরকার। শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অর্থ-সাহায্যও। সেসব মিলিয়ে খলিল নিজেই এখন একটি বাস কোম্পানির মালিক। জীবনে সচ্ছলতা এলেও সেই বীভৎস ঘটনার আতঙ্ক আজো মন থেকে মুছে যায়নি। বার্তা সংস্থা এএফপি খুঁজে পেল সেই আতঙ্কিত মানুষটিকেই, “প্রথমে ভেবেছিলাম, ওরা লাহোরের মানুষ আর পটকা ফুটিয়ে আনন্দ করছে। কিন্তু যখন দেখলাম, দুজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে এসে গুলি করা শুরু করেছে, বুঝতে পারলাম অন্য কিছু ঘটছে। ওদিকে খেলোয়াড়রা ‘যাও! যাও!’ বলে চিৎকার করে উঠল। এই শব্দটাই যেন আমার শরীরে ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা দিল। সংবিত ফিরে পেয়ে আমি জোর গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আমি নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রেখে খেলোয়াড়দের নিরাপদে স্টেডিয়ামে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম।’ খলিলের বিশ্বাস, সেদিন ১০ থেকে ১২ জন সন্ত্রাসী বাসে হামলা চালিয়েছিল আর তারা বাসটির পিছু নিয়েছিল স্টেডিয়াম থেকেই।
শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদেরও প্রশংসা করলেন ৪৩ বছর বয়সী খলিল, ‘বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর খেলোয়াড়রা আমাকে তাঁদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁদের বলেছিলাম, পরিবারকে ছেড়ে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’
তবে সেদিন না গেলেও তার কিছুদিন পর শ্রীলঙ্কায় ঠিকই যেতে হয়েছিল খলিলকে। শ্রীলঙ্কা-ভ্রমণের মধুর অভিজ্ঞতা আজো তাঁকে আবেগাপ্লুত করে তোলে, “মাসখানেক পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে আমি সে দেশে গিয়েছিলাম।বিমানবন্দরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন ড্রাইভার মেহের খলিল নই, একজন ভিভিআইপি। কোনো মার্কেটে কেনাকাটা করতে গেলে লক্ষ করতাম, লোকে আমাকে ‘হিরো’ বলে ডাকছে!” ‘হিরো’ খলিলকে ভিভিআইপি-মর্যাদায় দেশ ঘুরিয়ে, ২১ হাজার ডলার পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানিয়েছিল শ্রীলঙ্কা সরকার।
এবার আর জিম্বাবুয়ে দলের বাস চালাতে হচ্ছে না খলিলকে। কিন্তু সেদিনের কথা মনে হলে এখনো তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, ‘লিবার্টি চকের নাম শুনলে, কেউ নামটি উচ্চারণ করলেই আমার মাথার চুল যেন খাড়া হয়ে ওঠে। সেটা একটা ট্র্যাজিক ঘটনা ছিল। ওই ঘটনার কথা মনে না করাই ভালো!’