গন্তব্য প্লুটো: খুলছে বামনের জট?

নাসার প্রজেক্ট। গন্তব্য ‘প্লুটো’। ‘নিউ হরাইজন’ বা নতুন দিগন্ত সম্পর্কে অনুসন্ধানের নতুন এই প্রজেক্টে নাসার যানটি ছবির মাধ্যমে প্লুটো সম্পর্কে তথ্য পাবে। এটি একটি ‘ফ্লাইবাই’ বা পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া ক্যামেরা বিশেষ।
কথা ছিল ১৪ জুলাই, মঙ্গলবার, প্রায় এক দশকের মহাকাব্যিক যাত্রা শেষ করে, বামন গ্রহ প্লুটোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছবি তুলে পাঠাবে নাসার ‘নিউ হরাইজন ফ্লাইবাই’। সেটা সে করেছে। এই প্রথম মানুষের তৈরি কোনো যান, আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের প্রান্তের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে ছবি তুলে পাঠাল। মানব সভ্যতার জন্য অবশ্যই এক অসাধারণ মুহূর্ত। আর প্লুটোর জন্যও। ২০০৬ সালে প্লুটোকে গ্রহ থেকে বানিয়ে দেওয়া হয় ‘বামন গ্রহ’। এরপর থেকে প্লুটোকে ঘিরে এটিই সবচেয়ে বড় কোনো ঘটনা।
ছবি আসতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে সবাই প্রত্যাশায় আছে এই ছবিগুলো কী কী রহস্যের সমাধান এনে দেবে, তা নিয়ে।
প্লুটো আসলে দেখতে কেমন? প্লুটো নিয়ে আগ্রহীদের প্রথম প্রশ্ন এটাই।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টম্বো ১৯৩০ সালে প্রথম আবিষ্কার করেন ‘প্লুটো’। তাঁর সেই আবিষ্কারের পর অনেক যুগ পেরিয়ে গেছে। বিভিন্ন নভোযান কিংবা অন্যকিছুর মাধ্যমে চেষ্টা হয়েছে প্লুটোর ছবি তোলার। জানার চেষ্টা হয়েছে, গ্রহটি কেমন। তবে এত দিন পর্যন্ত সবচেয়ে কাছ থেকে তোলা যে ছবিটি মানুষের কাছে ছিল, তা ছিল হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা। অনেক দূর থেকে তোলা হয় ওই ছবি। ‘নিউ হরাইজন’ই একমাত্র ‘প্রোব’ বা পর্যবেক্ষণ অণুযন্ত্র যা এত কাছ থেকে ছবি তুলে পাঠাবে। এতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তাকে বলা হচ্ছে ‘লং রেঞ্জ রিকনেসেন্স ইমেজার’ বা ‘লরি’। এর ফলে বিজ্ঞানীরা অনেক বিস্তারিত চিত্র পাবেন এই বামন গ্রহটির। প্লুটোর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আরো স্পষ্ট ছবি পাঠাতে থাকবে এই ‘প্রোব’। সবচেয়ে ভালো ছবিটি তোলার কথা ১৪ জুলাই, যখন সে থাকবে প্লুটো থেকে সাত হাজার ৮০০ মাইল বা ১২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূরে। সেটা এসে পৌঁছেছে, গবেষণা চলছে। আরো তথ্য-উপাত্ত আসবে। আর তখন হয়তো খোলাসা হবে, ‘প্লুটো আসলেই কেমন?’
দ্বিতীয় যে প্রশ্নটির উত্তরের অপেক্ষায় সবাই আছে তা হলো, ‘প্লুটো কতটা বড়?’
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের একটি বিষয় হয়েছিল এই প্রশ্নের উত্তর। ‘প্লুটো ঠিক কতটা বড়?’ এই কয়দিনে পাওয়া তথ্য অনুসারে প্লুটোর ব্যাস দুই হাজার ৩৭০ কিলোমিটার, যা আগের অনুমানের চেয়ে বেশি। আমাদের সৌরজগতে অবস্থান করা এবং নেপচুনের কক্ষপথের চেয়েও দূরে থাকা অন্য’অবজেক্টে’র মধ্যে প্লুটোই সবচেয়ে বড়। নাসার বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্লুটোর আকারের যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তাতে প্লুটোর ঘনত্ব, আগের অনুমিত ঘনত্বের চেয়ে কিছুটা কম হবে। এর অভ্যন্তরে থাকা বরফের আনুপাতিক পরিমাণ কিছুটা বেশি হবে। আশা করা হচ্ছে প্লুটোর আকার সম্পর্কে আরো অনেক নিখুঁত তথ্য এনে দেবে এই মিশন। জানা যাবে ‘গ্রহটি সত্যিই কতটা বড়?’
প্লুটোর আকৃতিটা কেমন?
‘লরি’ থেকে পাওয়া ছবিগুলো থেকে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন প্লুটোর আকৃতিটা সম্পর্কে হয়তো এবার তাঁরা অনেক কিছু জানতে পারবেন। ৯ জুলাই, ‘প্রোব’টি যখন ৫.৪ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে ছিল, তখন পাঠানো ছবি থেকে প্লুটোর আকৃতি সম্পর্কে কিছু আন্দাজ পাওয়া যায়। প্লুটোর যে দিকটা সব সময় এর সবচেয়ে বড় ‘চাঁদ’ ‘স্যারনে’র দিকে মুখ করে থাকে, আর যেখানে তার বিষুব রেখা বরাবর তথাকথিত ‘তিমি মাছের আকৃতির কিছু একটা’র লেজ আছে, ছবিটি সেই দিককার। এখানে যা দেখা যাচ্ছে, তা মনে হচ্ছে এমন কিছুর, যার ভেতর বহুভুজের বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর তা পূর্ব থেকে উত্তর-পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত ১০০০ মাইল লম্বা একটি ভুখণ্ড।
পরবর্তী জানতে চাওয়া হচ্ছে প্লুটোর চাঁদ কেমন?
প্লুটোর বেশ কিছু চাঁদ আছে। এদের মাঝে চারটি ছোট আর একটি বড়, যার নাম স্যারন। ‘হাবল’ টেলিস্কোপের কারণে, ২০০৫ সালে দুটি ছোট চাঁদ ‘নিক্স’ এবং ‘হাইড্রা’ আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। ‘লরি’ ইমেজের কারণে বিজ্ঞানীরা এখন এ দুটি চাঁদ সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ছবি পাচ্ছেন। আড়াআড়িভাবে ‘নিক্স’ হচ্ছে আনুমানিক ৩৫ কিলোমিটার আর ‘হাইড্রা’ ৪৫ কিলোমিটার। তাদের পৃষ্ঠ বেশ চকচকে, সম্ভবত বরফের কারণে। অপর দুই ছোট চাঁদ ‘কেরবেরস’ আর ‘স্টিক্স’ আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। আশা করা হচ্ছে এদের সম্পর্কেও নতুন তথ্য সরবরাহ করবে এই ‘নিউ হরাইজন প্রোব’। জানা যাবে তাদের আকার সম্পর্কেও। জানার আগ্রহ রয়েছে প্লুটোর সবচেয়ে বড় চাঁদ ‘স্যারন’ সম্পর্কেও। পৃথিবীর ভূমিতে থাকা টেলিস্কোপ দিয়ে পরিমাপ করে আন্দাজ করা হয়েছে এর ব্যাস হবে আনুমানিক এক হাজার ২০০ কিলোমিটার।
শেষ যে প্রশ্নটির অপেক্ষায় রয়েছে বিজ্ঞানীরাও তা হচ্ছে, ওখানকার আবহাওয়া কেমন?
‘লরি’ যখন ব্যস্ত থাকবে বামন গ্রহটির আর এর চাঁদগুলোর আকার, ব্যাস এসব নিয়ে তথ্য পাঠাতে, যানটিতে রাখা বেশ কিছু সরঞ্জাম তখন শুকে দেখবে প্লুটোর পরিমণ্ডল। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে প্লুটোর পরিমণ্ডলে রয়েছে নাইট্রোজেন। ‘নাইট্রোজেনে’র সন্ধান পাওয়ায় বিজ্ঞানীরা বুঝে গেছেন, বামন এই গ্রহটি সম্পর্কে তাঁরা আগে যা ভেবেছিলেন, তা ছিল ভুল। প্লুটোর ওপর দেখা যাওয়া ‘বরফের টুপি’ বা ‘আইস ক্যাপ’ টি সম্ভবত নাইট্রোজেন আর মিথেনে তৈরি। আরও স্পষ্টভাবে জানা যাবে, যানটি প্লুটোর আরো কাছে এলে। আরো জানা যাবে প্লুটো আর এর চাঁদের পরিমণ্ডল কি একই রকম? না আলাদা?
কিছু ছবি এসেছে, আরো আসবে। তথ্য উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। কিছু তথ্য ইতিমধ্যে নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে আরো তথ্য আসবে। পুরোটা না হলেও, ‘প্লুটো’ রহস্যের আংশিক সমাধান হয়তো পেতে চলেছি আমরা।