তরুণ উদ্ভাবক
সাদ্দাম তৈরি করলেন আত্মরক্ষার অ্যাপ

কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে প্রায় সময়ই চাকরিজীবীদের সন্ধ্যা বা রাত হয়ে যায়। বাড়ি ফেরার পথে নিরাপত্তার একটা ঝুঁকি তো থাকেই, বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের। দূরবর্তী কোনো এলাকায় বাড়ি হলে গাড়ি পেতেও অনেক সময় লেগে যায়। সব মিলিয়ে সন্ধ্যার পর ছিনতাইকারী বা দুষ্কৃতকারীদের উৎপাতের একটা আশঙ্কা থাকে। একা চলাফেরার সময় দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণের শিকার হলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেবা পাওয়ার একটি উপায় বের করেছেন তরুণ ডেভেলপার মো. সাদ্দাম হোসেন শাহীন। তিনি তৈরি করেছেন সেলফ প্রোটেক্ট নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন।
এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সেলফ প্রোটেক্ট অ্যাপ নির্মাণ এবং এর কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানান সাদ্দাম। তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনে যখন জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) চালু হলো, তখন থেকেই জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে নিয়ে গবেষণা শুরু করি।’
এই গবেষণার শুরুটা হয়েছিল কেমন করে? সাদ্দাম জানালেন, ২০১২ সালে একদিন ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নিজের মোবাইল ফোন ও টাকা খোয়ান তিনি। এরপর ঠিক করেন, জিপিএস প্রযুক্তির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সংযুক্ত করা গেলে নিরাপত্তার বিষয়টি কিছুটা হলেও নিশ্চিত করা যায়।
২০১২ সাল থেকেই জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে অ্যাপটি তৈরির কাজ শুরু করেন সাদ্দাম। ২০১৪ সালে অংশ নেন পাঁচ দিনব্যাপী মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) তৈরির এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। এ সময় তাঁর প্রশিক্ষক ছিলেন কৃষ্ণ রায় মিথুন ও ফারুক আহমেদ জুয়েল।
পরে সেলফ প্রোটেক্ট অ্যাপ তৈরির সময় কারিগরি দিকগুলোর বিষয়ে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রশিক্ষকরা। অ্যাপটি তৈরি করতে দুই বছরের বেশি সময় লেগেছে সাদ্দামের। এখনো অ্যাপটির আরো উন্নত সংস্করণ তৈরিতে কাজ করছেন তিনি।
অ্যাপটি কীভাবে কাজ করবে? জানতে চাইলে সাদ্দাম বলেন, ‘অ্যাপটি প্রথমে স্মার্টফোনে ইনস্টল করতে হবে। অ্যাপটির দুটি অংশ। একটা হচ্ছে ক্লায়েন্ট বা ইউজার অ্যাপস, যা ব্যবহারকারীর স্মার্টফোনে থাকবে। আরেকটি হচ্ছে সার্ভার অ্যাপ বা নোটিফিকেশন রিসিভার অ্যাপ, যেটি পুলিশের কাছে বা পুলিশ স্টেশনে থাকবে।’
সাদ্দাম বলেন, ‘এর পর অ্যাপটি অ্যানাবেল (সক্রিয়) করতে হবে। নির্দিষ্ট বক্সে টিক চিহ্ন দিয়ে অ্যাপসটি সক্রিয় রাখতে হবে। সেবা পাওয়ার জন্য অ্যাপসটিকে সব সময় সক্রিয় রাখতে হবে, যাতে করে যেকোনো বিপদের সময় নির্দিষ্ট পাওয়ার বাটনটি পরপর চারবার চাপার সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে প্রয়োজনীয় তথ্যসহ বার্তা (নোটিফিকেশন) পৌঁছে যায়।’
‘বিপদে পড়লে বা অপরাধীদের আক্রমণের শিকার হলে আক্রান্ত ব্যক্তি তাঁর কাছে মোবাইল ফোনে থাকা সেলফ প্রোটেক্ট অ্যাপের নির্দিষ্ট বাটনটি চাপলে অ্যাপটি প্রথমে ব্যক্তির সবচেয়ে কাছের পুলিশ স্টেশনটির অ্যাপ খুঁজে বের করবে। তারপর জিপিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থান শনাক্ত করে পুলিশ স্টেশনের সার্ভারে জানাবে। ব্যবহারকারী যে এলাকায় আক্রান্ত হয়েছেন, সেখানকার আশপাশের শব্দ ও ছবি ধারণ করে পুলিশ স্টেশনে পাঠাবে অ্যাপটি, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির সাহায্যার্থে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে,’ বলেন সাদ্দাম।
সাদ্দাম বলেন, ‘পুলিশ স্টেশনের অ্যাপের সঙ্গে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছেও একই বার্তা মোবাইলে পৌঁছে যাবে টেক্সট মেসেজ আকারে। সার্ভারে পৌঁছানোর পর সংশ্লিষ্ট থানায় দায়িত্বরত নির্দিষ্ট সংখ্যক অফিসারের মোবাইল নম্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির নোটিফিকেশনটি টেক্সট মেসেজ আকারে পৌঁছে যাবে।’
সাদ্দাম জানান, অ্যাপটি ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারীর কোনো ইন্টারনেট কানেকশন বা ডাটা অন থাকার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট কানেকশন অফ থাকলেও জিপিএস চালু থাকার কারণে সার্ভিস প্রোভাইডার বা মোবাইল অপারেটরের সাহায্যে বার্তাটি পুলিশ স্টেশনে পৌঁছাবে।
তবে সার্ভার অ্যাপ্লিকেশন বা পুলিশের কাছে থাকা অ্যাপে ইন্টারনেট কানেকশন থাকতে হবে, যেন ব্যবহারকারী বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ বার্তাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার স্থানটি গুগল ম্যাপে দেখে শনাক্ত করা যায়।
আক্রান্ত ব্যক্তি একবার নির্দিষ্ট বাটন প্রেস করার মাধ্যমে যেভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য পুলিশের কাছে পৌঁছে যাবে, তেমনি ছিনতাইকারীরা ওই ব্যক্তির হ্যান্ডসেট থেকে সিম পরিবর্তন করলেও নির্দিষ্ট সময় পরপর ছিনতাইকারীর অবস্থানের তথ্য নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনের সার্ভারে আসতে থাকবে।
স্মার্টফোন ছাড়া সাধারণ ফিচার ফোনগুলোর জন্য সেটআপ টেক্সট অপশন থাকবে, যাতে করে টেক্সটটি নির্দিষ্ট এসএমএস সার্ভার নম্বরে মাধ্যমে পুলিশের সার্ভারে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের তুলনায় ফিচার ফোন ব্যবহারকারীরা একটু দেরিতে সেবা পাবেন।
অ্যাপটি ডেভেলপ করা হয়েছে অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের জন্য। এর পাশাপাশি উইন্ডোজ আর আইওএসের জন্যও অ্যাপটি ডেভেলপ করার কাজ চলছে।
অ্যাপটি জননিরাপত্তামূলক ও অপরাধ দমন-সংক্রান্ত হওয়ায় গুগল প্লে-স্টোর বা অন্যান্য মার্কেটপ্লেসে দিতে গেলে পুলিশ সদর দপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কারণ, অ্যাপটির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা প্রথমে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাবে এবং বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিটির সহায়তায় এগিয়ে আসবে।
এ জন্য পুলিশ সদর দপ্তর ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম (এটুআই) প্রকল্পে আবেদন করেছেন অ্যাপটির ডেভেলপার সাদ্দাম। সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে অ্যাপটি মার্কেটপ্লেসে আনা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সেলফ প্রোটেক্ট অ্যাপটি মার্কেটপ্লেসে ছাড়ার পর ব্যবহারকারীদের মতামতের ভিত্তিতে তা নিয়মিত আপডেট করা হবে। এ ছাড়া সাদ্দাম এখন OrbCoder (www.orbcoder.com) নামে একটি টিম নিয়ে বিভিন্ন নতুন উদ্ভাবনীমূলক মোবাইল অ্যাপ ও সফটওয়্যার নির্মাণের কাজ করছেন।
অ্যাপটির ডেভেলপার মো. সাদ্দাম হোসেন শাহীন বর্তমানে ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (চুয়াডাঙ্গা) বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।