হাইড্রোজেনের অণুকথা

পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের জন্য হাইড্রোজেনের ভূমিকা অনেক। মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলো হলো হাইড্রোজেনের চুল্লির মতো। আমাদের প্রিয় সূর্যি মামা, হাইড্রোজেনের ‘ফিউশন’ ছাড়া কিছুই না। ফিউশন হলো, দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস, একাকার হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। বিপরীতে, ফিশন (Fission) হলো কোনো নিউক্লিয়াস বিভাজিত হয়ে একাধিক নিউক্লিয়াসে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া।
তাহলে দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একীভূত হয়ে কী হয়? —একটি হিলিয়াম পরমাণু হয়। সাথে উৎপন্ন হয় প্রচুর শক্তি। সেই শক্তি, আলোক শক্তি হয়ে আসে দুনিয়ায়। আর সে আলো পেয়ে, উদ্ভিদ জগতে শুরু হয় সালোকসংশ্লেষণ। তৈরি হয় প্রচুর অক্সিজেন গ্যাস। আপনি-আমি দম ভরে যে বাতাস নেই, সেখানে অক্সিজেন না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। একটির সাথে আরেকটির কেমন বুনন, তাই না?
হাইড্রোজেন তো কোটি কোটি বছর ধরেই আছে। তবে এই পৃথিবীর মানুষ জানত না এর কথা। খুবই চুপচাপ স্বভাবের এক ব্রিটিশ কেমিস্ট, আবিষ্কার করেছিল এই গ্যাস। মজার বিষয় হলো, তিনি এই গ্যাস আবিষ্কার করলেও, বুঝতে পারেননি কী আবিষ্কার করেছেন। তাই এর কোনো নামও তিনি দেননি।
ভদ্রলোকের নাম ছিল হ্যানরি ক্যাভেন্ডিস। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব নামকরা ল্যাবরেটরির নাম ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরি (Cavendish Laboratory)। অনেকেই মনে করে, সেটি ওই কেমিস্টের নামেই করা হয়েছে। তবে তা ঠিক নয়। আসলে সেটি ক্যাভেন্ডিস পরিবারের নামানুসারে।
হ্যানরি ক্যাভেন্ডিস প্রায় আড়াইশ বছর আগে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের (HCl) মধ্যে দস্তা/জিংক (Zinc) মিশিয়েছিলেন। সাথে সাথে দেখলেন বুদবুদ করে বেরুচ্ছে এক গ্যাস। সংগ্রহ করলেন সে বর্ণহীন ও গন্ধহীন গ্যাস। পরীক্ষা করলেন। দেখলেন, আগুনের সংস্পর্শে এই গ্যাস খুব জ্বলে উঠে।
ক্যাভেন্ডিস তখন বোঝেননি তিনি হাইড্রোজেন গ্যাস আবিষ্কার করেছিলেন। প্রায় কুড়ি বছর পর ফ্রেঞ্চ কেমিস্ট ল্যাভয়সিয়ে সে গ্যাসের নাম দিলেন হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন শব্দের অর্থ ‘পানি উৎপাদক’—যেহেতু হাইড্রোজেন পুড়ে গিয়ে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ায় পানি উৎপন্ন করে।
প্রকৃতিতে হাইড্রোজেন সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মৌল। এর নিউক্লিয়াসে আছে একটি প্রোটন। কোনো নিউট্রন নেই। নিউট্রনহীন একমাত্র মৌল। তাই হাইড্রোজেনকে কথায় কথায় আমরা প্রোটনও বলি। তার আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়ামে যথাক্রমে একটি ও দুটি করে নিউট্রন থাকে।
হাইড্রোজেনকে পর্যায় সারণির কোথায় রাখা হবে সে নিয়ে একসময় হলো বিতর্ক। কেউ বলল, এর ধর্ম ধাতু (Metal) মতো, তাকে ধাতুর সাথেই রাখা হোক। কেউ বলল, এর ধর্ম অধাতুর মতো, একে অধাতুর সাথে রাখা হোক। মৌলের পারমাণবিক সংখ্যার (Proton number) ভিত্তিতে হাইড্রোজেনকে রাখা হলো গ্রুপ-I এ।
প্রাণ ধারণের অণু পানি। আর সে পানির প্রতিটি অণুতে, একটি অক্সিজেন পরমাণুকে ঘিরে কী মমতায় জড়িয়ে আছে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু। আমাদের প্রতিদিনের খাবারে আছে প্রচুর হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত যৌগ। বাড়িতে বাড়িতে যে গ্যাস জ্বালাই, সে গ্যাসে থাকে হাইড্রোজেন পরমাণু। এই আলোকিত ধরার নেপথ্য চরিত্র যদি হয় হাইড্রোজেন, তাহলে তার প্রতি এক ধরনের মায়া জাগতেই পারে আমাদের।
লেখক : গবেষক, স্টকহোম ইউনিভার্সিটি, সুইডেন।