এক অদ্ভুত গ্রাম আন্দারমানিক
আন্দারমানিক এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম। একসময় আন্দারমানিকে ছিল মূল মেঘনা নদীর অস্তিত্ব। সেখানে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা নিয়ে ছুটতেন। শিকার করতেন রুপালি ইলিশ। সেই আন্দারমানিকে মেঘনা নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রবল ভাঙনের মুখে মেঘনা নদী গতি পরিবর্তন করে অন্য দিকে চলে যায়। ৭৯ বছর আগে নদীর বুকে সৃষ্টি হয় একটি চর। চরটি জেগে ওঠার শুরুতে মানুষের তেমন বসতি ছিল না। তবে ধীরে ধীরে চর যখন মানুষের বসতি স্থাপনের উপযোগী হয়ে ওঠে এবং চরটি মানুষের বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, তখন মানুষ এ চরে বাস করা আরম্ভ করে। মানুষের জীবন-জীবিকার এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয় আন্দারমানিকে। এ গ্রামের মানুষের জীবন অন্যান্য এলাকার মানুষের চেয়ে অনেকটা সংগ্রামমুখর।
আন্দারমানিক গ্রামটি মেঘনা উপকূলবর্তী লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত। আন্দারমানিকের অন্ধকার যেন কাটছেই না। কৃষি, মৎস্যজীবী, দিনমজুর, রাখাল সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে এ চরের সভ্যতার যাত্রা। মূলত চরে চাষাবাদ, মাছ শিকার এবং গরু-মহিষের মতো গবাদিপশু পালনকারী মানুষ আন্দারমানিককে জীবিকার প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়। সময়ের পরিক্রমায় এ চরে মানুষের বসত গড়ার পরিমাণও বেড়ে যায়। মেঠোপথ আর সাঁকোর মাধ্যমে একসময় গড়ে ওঠে এ চরটির সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা। পিছিয়ে পড়া জনপদ সত্ত্বেও নদীভাঙনে বাড়ি-ঘর হারানো মানুষ, ভূমিহীন, দারিদ্রপীড়িত মানুষের বসাবসের আশ্রয় হয়ে ওঠে চরটি। কী কারণে চরটির নাম আন্দারমানিক হয়েছে, তা জানেন না স্থানীয়রা। কিন্তু নামকরণের সঙ্গে চরটির যথেষ্ট মিল রয়েছে বলে জানান তাঁরা।
আন্দারমানিকে যা যা দেখবেন
ভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় গ্রামের নাম আন্দারমানিক। গ্রাম-বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য আন্দারমানিক গ্রামের একটি অনন্য রূপ। আন্দারমানিক গ্রামে পা রাখলে চোখে পড়ে ফসলি মাঠের বুক চিরে বয়ে গেছে মেঠোপথ, মানুষের নতুন নতুন বসতি, ধান, সয়াবিন, মরিচসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ, বিস্তৃতজুড়ে সবুজের মাঠ, খড়কুটোয় গড়া ছোট্ট ঘর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য, বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকা বিলের অপরূপ সৌন্দর্য কিংবা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ দেহের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। গ্রামের মানুষের বসতঘর বর্তমানে টিনশেড ও আধাপাকা। তা ছাড়া গ্রামের মানুষ ব্যক্তি-উদ্যোগে এখন মাছের প্রজেক্ট গড়ে তুলেছেন, তরুণদের মধ্যে হাঁস-মুরগি পালনেরও প্রবণতা লক্ষ করা যাবে।
যেভাবে যাবেন আন্দারমানিক
সড়কপথে গেলে, রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে লক্ষ্মীপুর শহরের ঝুমুর স্টেশনে নামতে হবে। জলপথে গেলে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চে করে চাঁদপুর হয়ে একই স্থানে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি যোগে লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের তোরাবগঞ্জ নামবেন। তারপর তোরাবগঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে ডিপটির ঘর। ডিপটির ঘর থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে গেলেই দেখা মিলবে আন্দারমানিকের। লঞ্চে গেলে খরচ হবে আসা-যাওয়া মোট ৭৬০ টাকা; আর সড়কপথে বাসে করে গেলে মোট আসা-যাওয়ার খরচ পড়বে ৮৬০ টাকা। তবে লঞ্চে কেবিন নিলে খরচ একটু বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে এক কেবিন ৫০০ টাকা।
যেখানে থাকবেন
লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে উন্নত মানের বেশ কিছু গেস্ট হাউজ গড়ে উঠেছে। উন্নত মানের দুটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। বাগবাড়ির ঐতিহ্য কনভেশন ও স্টার গেস্ট হাউজ এবং চকবাজারের সোনার বাংলা আবাসিক রেস্টুরেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধা হাউস অন্যতম। সেক্ষেত্রে আপনাকে খরচ গুনতে হবে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা।
কোথায় খাবেন?
খাওয়ার জন্য গেস্ট হাউসগুলোতে সাধারণত ব্যবস্থা থাকে। তারপরও জেলা শহরে কয়েকটি হোটেল আছে। সেগুলো হলো—রাজমহল হোস্টেল অ্যান্ড চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, রহমানিয়া হোটেল, হোটেল নুর জাহান ও হোটেল মোহাম্মাদীয়া। আপনার রুচিমতো সব খাবারের সমাহার পাবেন এ হোটেলগুলোতে।
সতর্কতা
আন্দারমানিক যেহেতু একটি পশ্চাৎপদ জনপদ, সেজন্য আপনাকে অবশ্যই বেশ কিছু সতর্কতা মেনে চলতেই হবে। আন্দারমানিকের চলাচলের রাস্তা সাধারণ মেঠোপথ। বর্ষাকালে মেঠোপথগুলো পিছলে হয়ে থাকে। বাইক নিয়ে গেলে কিংবা হাঁটার সময়ও সাবধানতা আবশ্যক। বড় ধরনের গাড়ি নিয়ে আন্দারমানিকে যাওয়া যাবে না। সিএনজিচালিত অটো রিকশায় চলতেও সতর্কতার প্রয়োজন আছে। আর সন্ধ্যা নামার আগেই আপনাকে আন্দারমানিক থেকে ফিরতে হবে। না হয় দিক হারানোর শঙ্কাও থাকতে পারে। আর কোনো গাইড নিয়ে যেতে পারলে সেটা আরো ভালো হয়। সব মিলিয়ে আপনার ভ্রমণ হোক রোমাঞ্চকর।