ঢাকার পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়ক: কীভাবে যাবেন, কী দেখবেন
দেশজুড়ে দিন বদলের এই হাওয়ার সবচেয়ে বেশি সান্নিধ্য পেয়েছে রাজধানী ঢাকা। ছোট্ট ভূখণ্ডে আকাশসম জটিলতা নিয়ে বিশ্বমানের সভ্যতার সঙ্গে তাল মেলানো শুরু করেছে প্রায় ৪০০ বছরেরও পুরানো এই শহর।
ঢাকার পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়ক যেন তারই ঘোষণা দিচ্ছে। উপশহর গড়ার লক্ষ্য নিয়ে ঢেলে সাজানো এই বিস্তৃত অঞ্চলটি ইতোমধ্যে পরিণত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন এক্সপ্রেসওয়েতে। চলুন, খুব শিগগিরই উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা নতুন এই মাইলফলকের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
বিশ্ব মানের ৩০০ ফিট সড়ক
সংশোধিত নকশায় ২৩৫ ফিট হলেও পূর্বের নামেই এখনও পরিচিত কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত সাড়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটি। মূলত প্রস্থ বরাবর ৩০০ ফিট সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের সূচনালগ্ন থেকেই প্রসিদ্ধি লাভ করে ৩০০ ফিট নামটি।
এখন কুড়িল থেকে সড়কটি ১৪ লেনে ভাগ হয়ে সাড়ে ৬ কিলোমিটার চলে গেছে বালু ব্রিজ পর্যন্ত। ১৪ লেনের ৮টি এক্সপ্রেসওয়ে, যে পথে দ্রুতগামী যানবাহনগুলো ঢাকার বাইরে থেকে যাওয়া-আসা করবে। আর ৬টি হলো সার্ভিস রোড, যেগুলোতে চলাচল করবে স্থানীয় গাড়িগুলো।
তারপর বালু ব্রিজের পর থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়কটি ১২ লেনের। এখানে ৬টি এক্সপ্রেসওয়ে, ৬টি সার্ভিস রোড।
এগুলোতে না আছে কোনো স্টপওভার পয়েন্ট, না কোনো ট্র্যাফিক সিগনাল। কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই আপন গতিতে চলতে পারবে প্রতিটি যানবাহন। সার্ভিস লেন থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে যাওয়ার জন্য পুরো সড়কটিতে নির্দিষ্ট দূরুত্ব পর পর রয়েছে মোট ৫টি এ্যাটগ্রেড ইন্টার-সেকশন। এগুলোর নিচের আন্ডারপাস বা পাতাল সড়ক দিয়ে গাড়িগুলো চলে যেতে পারে এক্সপ্রেসওয়েতে। এরকম পাতাল সড়ক রয়েছে ১২টি।
বালু ব্রিজসহ ৬টি প্রশস্ত সেতু তো আছেই, সেই সঙ্গে হাতিরঝিলের আদলে বানানো হয়েছে ১৩টি আর্চ ব্রিজ। এগুলোর মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী এলাকার ছোট ও মাঝারি গাড়িগুলো সার্ভিস লেন হয়ে ঢুকতে পারে মূল সড়কে। পাখির চোখে দেখলে ৪টি আইলুপ আলাদা করে দৃষ্টি কাঁড়ে।
এছাড়াও রয়েছে ৩০০ ফিটের সব থেকে চোখে পড়ার মতো বিষয় হচ্ছে সড়কের দু’পাশে ১০০ ফুটের দৃষ্টিনন্দন খাল। এর পাশ দিয়ে ৩৯ কিলোমিটার পায়ে হাটা পথ রীতিমতো উদ্যানে পরিণত করেছে জায়গাগুলোকে।
৩০০ ফিটে রয়েছে ১টি পাম্প হাউজ এবং খালের পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে ৫টি স্লুইস গেট। পানি গিয়ে মিলিত হয়েছে বালু নদীতে।
বর্ষা মৌসুমে আশেপাশের আবাসিক এলাকাসহ বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসণকল্পে আরও খাল খননের কাজ চলছে। পার্শ্ববর্তী ডুমনি, বোয়ালিয়া ও এডি-৮ খালের পানি এক হয়ে এসে মিশবে এই ১০০ ফুট খালের সঙ্গে। এডি-৮ খাল খনন করা হবে ৪ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ করে, আর বোয়ালিয়া খাল হবে ৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ। ৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ করে খনন করা হবে ডুমনি খাল। ৩০০ ফিট সড়কের খালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনটি খালেরই প্রস্থ ১০০ ফুট রাখা হবে।
ঢাকার ৩০০ ফিট সড়কের অবস্থান
সড়কটির অবস্থান ঢাকার উত্তর-পূর্ব দিকে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানায়। শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর মাঝখানে প্রায় ৬২১৩ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে মনোরম সড়কটি। ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করেছে এই বিরতিহীন সড়কটি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, নারায়ণগঞ্চ, নরসিংদী, গাজীপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, ও কিশোরগঞ্জ। মূলত ৩০০ ফিটের মাধ্যমে ঢাকার পশ্চিমাংশের সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যাতায়াত পথ সুগম হয়েছে।
বিমান বন্দর সড়ক ও প্রগতি সরণির সঙ্গে ঢাকার পূর্বের ইস্টার্ন বাইপাসের সংযোগ ঘটায় বহিরাগতরা ঝামেলাবিহীন ভাবে নানা গন্তব্যে যেতে পারবেন।
এছাড়া ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে নামে নির্মাণাধীন এক্সপ্রেসওয়েটি পূর্বাচল ১০০ ফিট মাদানী এভিনিউকে সংযুক্ত করবে এই সড়ক
ঢাকা পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কে যাওয়ার উপায়
ঢাকার গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে সড়কটির দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে উত্তরাগামী যে কোনো বাস কুড়িল হয়ে যায়। কুড়িলে বাস থেকে নেমে নারায়ণগঞ্চ বা নরসিংদীগামী বাসে করে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। এছাড়া সিএনজি বা বাইকে করেও ঘুরে আসা যাবে ৩০০ ফিট। ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলে ভ্রমনের আনন্দটা আরও একটু বাড়িয়ে নেওয়া যাবে।
এছাড়া মেট্রোরেলের এমআরটি (মাস র্যাপিড ট্রানজিট) লাইন-১ এই এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাবে। এটি সফল হলে কমলাপুর বা তার পরবর্তী নানা স্থান থেকে দর্শনার্থীরা উড়াল সড়কপথে মেট্রোরেলে করেই চলে আসতে পারবেন এখানে।
৩০০ ফিট সড়কে ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময়
এখানে ভয় নেই কোনো পাহাড়ি পথে পা পিছলে যাওয়ার। এছাড়াও আশঙ্কা নেই জোয়ার-ভাটা বা জঙ্গলের শাপদসংকুলতার। ৩০০ ফিট ১২ মাসই সমান আকর্ষণীয় দর্শনার্থীদের কাছে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় লোকজনসহ ঢাকার দূর-দূরান্তের লোকেরাও সময় কাটাতে আসেন এখানে।
তবে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর সৌন্দর্য্যটা উপভোগ করতে হলে বৃষ্টির মৌসুম তথা জুন-জুলাইয়ের দিকে আসাটা উত্তম।
উষ্ণ ও শুষ্ক মৌসুমগুলোতে রোদ থেকে বাঁচার অবস্থা থাকবে না। তবে ১০০ ফুট খালের দু’পাশে লাগানো ছোট গাছগুলো বড় হয়ে গেলে ছায়ার ব্যবস্থা হবে। সেই সঙ্গে চারপাশের সৌন্দর্য্যটা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
এক্সপ্রেসওয়ের দু’ধারে শরতের কাশবন মুগ্ধতা ছড়ায় অক্টোবরের প্রথম দিকে। তাই এই সময় ছাড়া পিচঢালা রাস্তার সঙ্গে শুভ্রতার অপূর্ব মেলবন্ধনের সাক্ষী হওয়া যাবে না।
পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কে যা দেখবেন
১০০ ফুট খালে ছাড়া হবে ওয়াটার বাস, যেগুলো মোট ১২টি স্টপেজ থেকে যাত্রী তুলবে। খালের দু’পাশের পায়ে হাটা পথে কিছুটা সময়ই যথেষ্ট ব্যস্ত জীবনের সব ক্লান্তি ভুলে যাওয়ার জন্য। এমনকি নিরাপত্তা দেয়ালগুলোও যেন নিজেদের মতো করে শোভাবর্ধনের কাজে অংশ নিচ্ছে।
সড়কের দু’পাশজুড়ে রয়েছে সারিবদ্ধ লাইটপোস্ট। রাস্তার মাঝখান দিয়ে মেট্রোরেলের লাইন যাবে বলে ওখানে লাইট লাগানোর কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। এরপরেও সন্ধ্যার পরে নয়নাভিরাম আলোকসজ্জায় মনেই হয় না যে এটা বাংলাদেশের কোনো জায়গা।
সারাটা পথে নান্দনিক নকশার ৬টি ফুটওভার ব্রিজ যে কোনো শৈল্পিক মনকে চমকে দিতে পারে। এগুলোতে দাড়িয়ে প্রাণভরে উপভোগ করা যেতে পারে নিচের সবুজ আইল্যান্ড ও পিচঢালা রাস্তার প্যাটার্ন, আর দু’পাশের নীল লেক।
বালু ব্রিজে দাড়িয়ে নিচের বালু নদীর দিকে তাকিয়েও অনেকে সময় কাটান। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত যেতে মাত্র ৭ থেকে ১০ মিনিট সময় লাগে। তাই ঢাকার কাছেই এক দিনের ভ্রমণের জন্য এটি উপযুক্ত একটি জায়গা।
এছাড়া নদীর উপরের ব্রিজগুলোর বাইপাস রাস্তা ধরে নিচে নেমে অনেকেই নৌকা ভ্রমণ করেন।
পূর্বাচল ৩০০ ফিটের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান হচ্ছে নীলা মার্কেট। বালু ব্রিজ পার হয়ে ইন্টারসেকশন বা ইউলুপ দিয়ে ডানেই নীলা মার্কেট। খাবারের দোকান ও ছোট্ট শিশু পার্ক মিলে পুরো জায়গাটি প্রায় মেলার মতো হয়ে থাকে। এখানকার হাঁসের মাংস দিয়ে চিতই পিঠা, গরম মিষ্টিসহ বালিশ মিষ্টি বেশ প্রসিদ্ধ খাবার। এছাড়াও রয়েছে স্পঞ্জ মিষ্টি, ভাজা মাছ সহ বিভিন্ন ধরনের বাঙালী খাবার।
কাছাকাছি জায়গায় গ্রাম্য ঘরানায় গড়ে উঠেছে নানান ধরণের রেস্তোরাঁ, যেগুলোতে উদরপূর্তির পাশাপাশি ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে। এছাড়া শরতকালে ভোলানাথপুর কবরস্থানের রাস্তায় কিছুটা ভিতরের দিকে গেলেই চোখে পড়বে কাশফুলের রাজ্য।
কাঞ্চন ব্রিজ সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে আছে বেশ কিছু রিসোর্ট ও বিনোদন পার্ক। ঢাকার বাইরে থেকে এলে বা এখানে রাত্রি যাপন করার ক্ষেত্রে এই রিসোর্টগুলো দারুণ অভিজ্ঞতা দিতে পারে।
কাঞ্চন ব্রিজ থেকে বায়ে সিটি বাইপাস দিয়ে ১ কিলোমিটার ভেতরে গেলে হাতের ডান পাশে পড়বে জিন্দা পার্ক। পূর্বাচলের কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জ জেলাস্থ এই পার্কটি পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সময় কাটানোর জন্য দারুণ একটি জায়গা।
ভ্রমণকালীন কিছু সতর্কতা
- এখানে কোনো বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই নিজস্ব গতিতে প্রতিটি চালক গাড়ি চালাতে পারেন। এরপরেও গতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে গাড়ি চালানো উচিৎ।
একক বা দলগত যে কোনো ভ্রমণের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে নিরাপদ। কিন্তু সড়ক থেকে ডানে ও বায়ের জায়গাগুলোতে ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে লোকালয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ। একদম জনমানবশূন্য স্থানগুলোতে না যাওয়াটাই ভালো।
এমন বিশ্ব মানের একটি অবকাঠামো প্রতিটি দেশবাসীর জন্য গর্বের। তাই এই গর্বের জিনিসটিকে পরিষ্কার রাখাটাও তাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
ভ্রমণ মানেই হৈচৈ; কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ যেন অন্যান্য দর্শনার্থীদের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাড়ায়। এমন কোনো কিছু করা উচিৎ নয়, যাতে বহিরাগতদের স্থানীয়দের ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।
পূর্বাচল সংলগ্ন এলাকায় ও তার আশেপাশে আবাসন প্রকল্পগুলোর দৌলতে স্থানীয় ঘনবসতিতে বিপুল সংখ্যা যোগ হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। এই পরিপ্রেক্ষিতে, ঢাকার পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়ক এক পরিকল্পিত নির্ঝঞ্ঝাট যাতায়াত ব্যবস্থার অবতারণা করেছে। যাতায়াত খাত থেকে রাজস্ব আয়ের সুযোগ তো থাকছেই; সেই সঙ্গে সমূহ সম্ভাবনা উন্মুক্ত হচ্ছে পর্যটন শিল্পের প্রসারের।
একদিকে রাজধানীবাসীদের জন্য বাড়ির কাছেই মিটবে মুক্ত বাতাসে অবকাশ যাপনের সাধ। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রবেশপথ সহজ হওয়ায় বাংলাদেশকে নতুন করে চিনতে শুরু করবেন বিদেশি পর্যটকগণ।