দুর্গম ঝর্ণার রোমাঞ্চকর যাত্রা
পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য। আরও বেশি সৌন্দর্য, পাহাড়ের পেটে ঝরা ঝর্ণায়। চোখ ধাঁধানো, মন জুড়ানো। এ পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো পাঁচ দিন। হেঁটেছি বান্দরবানের থানচি থেকে রুমা উপজেলার দুর্গম সব পাহাড়ে। দেখেছি, ছয়টি ঝর্ণার মায়াবী রূপ। পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস করা পাহাড়িদের জীবনাচরণ দেখেছি, শুনেছি তাদের টিকে থাকার গল্প।
তবে পাহাড়ি এ পথ অনেক কঠিন। যদিও তারচেয়ে বেশি নান্দনিক। জীবনের ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর সময়গুলো নিয়ে এ লেখা। আজ থাকছে যার প্রথম পর্ব। চলুন, পাহাড় অভিযানের শুরু থেকে হেঁটে আসি।
মন বেশ ফুরফুরে ও রোমাঞ্চিত। কয়েকদিনের প্রস্তুতি আর কেনাকাটা শেষ। ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে রওনা হয়েছি, উদ্দেশ্য বান্দবানের থানচি। সকালে বান্দরবান শহরে পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নেই। চলে যাই থানচি বাসস্ট্যান্ডে। আমার সঙ্গে ছিলেন ফেসবুকভিত্তিক ‘চলঘুরি বাংলাদেশ’ নামের ভ্রমণ বিষয়ক একটি দলের আরো সাতজন। আটটি টিকিট কেটে ওঠে পড়ি বাসে। যাত্রা শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। বাস চলছে, উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে। সবুজে-শ্যামলে মোড়ানো একেকটি পাহাড়। পাহাড়ের মাঝে জুমের সোনালি ধান। মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছিল জুমঘর।
২৬ কিলোমিটার চলার পর পৌঁছাই চিম্বুক পাহাড়ে। এরপর কিছুক্ষণের জন্য বাসের যাত্রা বিরতি। সেখানে পাহাড়ি পেঁপে নিয়ে বসেছিলেন এক বিক্রেতা। দুটি পেঁপে কিনি ৫০ টাকায়। তিনিই কেটে দেন। খাওয়ার পর মনে হয়েছিল, এত মিষ্টি ও সুস্বাদু পেঁপে আগে কখনো খাইনি।
এরপর আবার বাস চলতে শুরু করে। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর চালক বললেন, সবাইকে বাস থেকে নেমে একটুখানি হেঁটে যেতে হবে। নামার পর দেখি, সামনে বিশাল খাড়া পাহাড়। রাস্তার কিছু অংশ ভেঙে বেশ বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ওই অংশ অতিক্রম করে আবার বাসে উঠি। উঁচু নিচু ও আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এগুচ্ছিল বাস। দুর্ঘটনা এড়াতে পাহাড় থেকে নিচে নামার সময় খুব ধীরে ধীরে নামছিলেন চালক।
বেশ অনেকক্ষণ পরে আবার থামল বাস। চালক বললেন, ট্যুরিস্টরা সবাই নামেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ফটোকপি জমা দিয়ে নাম নথিভুক্ত করে আসেন। বাস থেকে নেমে দেখি, সামনে থানচির বলিপাড়া বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর। সেখানে আমাদের সবাইকে একটি ফরম পূরণ করে সই দিতে হলো, জমা দিতে হলো এনআইডির ফটোকপি। এরমধ্যে বিজিবি জানতে পেরেছে, আমি সাংবাদিক। এরপর আমাকে নানা ধরনের জেরা করা শুরু। কেন এখানে, কী কাজ করতে এসেছিসহ নানা প্রশ্ন। অনেক প্রশ্ন-উত্তরের পর আমাদের থানচি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
এভাবে আকাঁবাঁকা পথ পেরিয়ে যখন আমরা থানচি পৌঁছাই, তখন বিকেল ৩টা। সঙ্গে থাকা ব্যাগগুলো একটি খাবারের হোটেলে রাখলাম। হাত-মুখ ধুলাম। এরপর আমি আর রনী ভাই সাঙ্গু নদীতে নামলাম। গোসল করলাম। মনে হলো, শরীর ডুবিয়ে মন ভেজালাম!
গোসল শেষে কাপড়-চোপড় মেলে দুপুরে ভরপেট খেলাম। এরপর শুরু অপেক্ষার পালা। অপেক্ষা সন্ধ্যা হওয়ার, অন্ধকার নামার আর পাহাড়ি পথে দৌড়ানোর! আটজনই অপেক্ষা করে চলেছি। শোনা যাচ্ছে, আমাদের চাল-চলন দেখে কেউ কেউ খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছেন। আমরা আতঙ্কিত। চোরের মন পুলিশ পুলিশ যাকে বলে অবস্থা।
তখন সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। হঠাৎ আমাদের স্থানীয় পথনির্দেশক (গাইড) বললেন, ‘কুইক গুছিয়ে নেন, এখনি বের হতে হবে। এখানে অনেকে আড়ি পেতেছে। সমস্যা হতে পারে আমাদের।’ গাইড জানালেন, আমরা থানচির বাকত্লাই পাড়ায় গিয়ে রাত্রিযাপন করব। এ পথের নিয়ম হচ্ছে, গাইডের নির্দেশ শিরোধার্য।
শুক্রবার, ঠিক সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিট। গাইড বললেন, ‘সাঙ্গু নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়ান। আমি সবাইকে নিয়ে আসছি।’ বললেন, ‘আমার সংকেত ছাড়া কেউ এক পাও নড়বেন না। আমি পেছনে আছি।’ আমরাও সজাগ। এ পথ এক অদ্ভুত নতুন পথ। নদীর পাড় ঘেঁষে আমরা কয়েক মিনিট হাঁটলাম। এরপর একটি পাড়ার মধ্য দিয়ে ছোট্ট নালা পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠা পর্বের শুভ সূচনা হলো আমাদের।
এই প্রথম উঁচু পাহাড়ে হাঁটার সুযোগ হলো আমার। প্রথম পাহাড়ি অভিযান। এক দৌড়ে বেশ খানিকটা উঠলাম। আমার সামনে শুধু গাইড। অন্যরা পেছনে। গাইডের নির্দেশ, কোনো সাড়াশব্দ করা যাবে না। অন্ধকারে হাঁটতে হবে। আলো জ্বালানো যাবে না। খুব বেশি আলোর প্রয়োজন হলে বা জোঁকে ধরলে মুঠোফোনের আলো জ্বালাতে হবে। মাথায় থাকা ‘হেড ল্যাম্প’ বন্ধ করতে বাধ্য হলাম। তাঁর নির্দেশনা মেনে পাহাড়ে উঠছি। মনে হচ্ছিল, নিচ থেকে কেউ পা টেনে ধরছে।
এভাবে মিনিট দশেক পাহাড়ে হাঁটার পর বুকের মধ্যে দুরুদুরু শুরু হয়ে গেছে। তবু হাঁটতে হবে। পাহাড়ি বাগানে প্রচণ্ড মশা। কামড়েই চলেছে। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর লক্ষ্য করলাম, কারও কারও হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। তাঁরা বসে পড়েছেন। গাইডকে দাঁড়াতে বললাম। তিনি রেগে-মেগে বলে উঠলেন, ‘আমার কথার বাইরে যাওয়া যাবে না। দাঁড়ানো যাবে না। বসা যাবে না। আস্তে-ধীরে হলেও হাঁটতে থাকতে হবে। নতুবা ধরা পড়লে আমার-আপনাদের, সবার সমস্যা হবে।’ তবু গাইড মিনিট দুয়েক বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিলেন।
পাহাড়ের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত পোকামাকড়ের ডাক। যেন পুরো পাহাড়ই তাদের দখলে। শরীরের অনাবৃত অংশে খাবলে ধরছে মশাসহ নানা পোকামাকড়। মুঠোফোনের আলোতে যেন আরও বেশি আছড়ে পড়ছে। এভাবেই অনেক নিচ থেকে উঁচু পাহাড়ি পথ বেয়ে যাত্রা শুরুর ঠিক ৩০ মিনিট পর অর্থাৎ, ৬টা ৫০ মিনিটে আমরা থানচি-লিক্রি সড়কের একটি ঝোপের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখন আমাদের অপেক্ষা চাঁদের গাড়ির। গাইড জানালেন, ‘এখুনি গাড়ি এসে যাবে’। কিন্তু, গাড়ি আর আসে না।
একটি বাগানের ভেতর অপেক্ষা করছি। মশার কামড়ে তখন সবাই অতিষ্ঠ। এর মধ্যে আবার একজনের পায়ে জোঁকের চুম্বন। রক্ত ঝরছে। তবু সবাই চুপচাপ। রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যেই গাড়ি যাচ্ছে। আমরা ভাবছি, এই বুঝি আমাদের নিতে আসছে। পরে বোঝা যাচ্ছিল, সেগুলো মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি। আমরা অপেক্ষায়। গাড়ি আসবে, আসবে; কিন্তু আসে না!
গাইড কাকে যেন বারবার ফোন দিচ্ছেন। জানতে চাচ্ছেন, ‘আর কত সময় লাগবে? দ্রুত আসেন।’ এদিকে আমাদের আটজনের একজন পাহাড়ে উঠতে উঠতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পানি খেতে চাচ্ছিলেন বারবার। এদিকে আমাদের কারও কাছে তেমন পানি নেই। পানি না থাকার কারণ, সন্ধ্যায় বের হতে গাইড এত তাড়াহুড়ো করেছিলেন যে; পানি নিতে আমাদের মনেই ছিল না। আমার একটি গেঞ্জি-প্যান্টও ফেলে এসেছি ওই হোটেলে।
শারীরিক অসুবিধা ও শঙ্কা নিয়ে আমরা আস্তেধীরে টুকটাক কথা বলছিলাম নিজেদের মধ্যে। এমন সময় গাইড ফের বলে উঠলেন, ‘কেউ লাইট জ্বালাবেন না। বিড়ি ধরাবেন না। কোনো কথা বলবেন না। আমাদের গাড়ি এসে যাবে দ্রুতই।’ কিন্তু, গাড়ি আর আসে না!
এ যাত্রায় অনেকেই বিরক্ত হলেও আমি বেশ রোমাঞ্চিত। ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা। ক্লান্তিও অনুভব করছিলাম না। আমরা গাড়ির অপেক্ষায়। এভাবেই কাটছে। এর আরও ৩০ মিনিট পর অর্থাৎ, ৭টা ২০ মিনিটে একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল আমাদের কাছাকাছি। আমরা তল্পিতল্পা গুছিয়ে গাড়ির দিকে এগুচ্ছি। এমন সময় গাইড বলে উঠলেন, ‘দ্রুত পালান, জুম ঘরের পেছনে যান সবাই; এ গাড়ি আমাদের না!’ আবার সবাই দৌড়ে জুম ঘরের পেছনে লুকিয়ে পড়ি।
এ পরিস্থিতির ঠিক পাঁচ মিনিট পর, এবার আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই চাঁদের গাড়িটি এসে দাঁড়াল! আমরা তড়িঘড়ি গাড়িতে উঠলাম। উঠতে গিয়ে একজন সহযাত্রী সটান নিচে পড়ে গেলেন। গাইড জানিয়ে দিলেন, সিটে বসা যাবে না। পা রাখার স্থানে শুয়ে থাকতে হবে। কারও মাথা দেখা গেলে সমস্যা, সে কথাও জানিয়ে দিলেন। মনে হচ্ছিল, অবৈধ পথে কোনো দেশের সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছি। শাঁ শাঁ শব্দে গাড়ি চলছে।
গাড়ি চলতে চলতে ঠিক আট মিনিট পর একটি স্থানে গিয়ে গাড়ি থামল। তারপর আমাদের বলা হলো, এখন সিটে বসতে পারি! পাহাড়ি ভাষায় কথা বলছিলেন চালক ও গাইড। পাহাড়ি রাস্তায় যত ওপরে উঠছি, আকাশের লক্ষ লক্ষ তারা যেন তত কাছে চলে আসছিল। অদ্ভুত সুন্দর, চোখ ধাঁধানো। খোলা চাঁদের গাড়িতে দাঁড়িয়ে অপলক দেখছিলাম। মুঠোফোনে ভিডিও করছিলাম।
সন্ধ্যা ৭টা ৪৮ মিনিট। আমরা ওপরে উঠছি। পাহাড়ি পথ বেয়ে আরেকটি গাড়ি নামছে নিচের দিকে। আবার আতঙ্ক, এই বুঝি সব গেল! চুপ হয়ে গেলাম সবাই। তবে আমাদের চালক বললেন, ‘এখানে উনারা (সেনা) আসেন না।’
আমরা পূর্বের তালে ফিরে গেলাম। উজ্জীবিত হয়ে উঠলাম। ঠিক ৭টা ৫১ মিনিটে ‘১০ কিলোমিটার’ নামক স্থানে গাড়ি থামল একটি দোকানের সামনে। শুকিয়ে যাওয়া গলা ভেজাতে পেটপুরে পানি খেলাম। পুনরায় গাড়ি চলতে শুরু করল। রাত ৮টা ১৯ মিনিটে ‘১৬ কিলোমিটার’ নামক স্থানে আমাদের গাড়ি শেষবারের মতো থামল। এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাকত্লাই পাড়ার দিকে রওনা দিই। আবারও সেই বিধিনিষেধ। লাইট জ্বালানো যাবে না।
বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে আমি, প্রিন্স, শাকিল, কামাল, সানজিদ, মেহেদী, রুবেল ও রনী ভাই বাকত্লাই পাড়ায় পৌঁছাই। চুপচাপ উঠি গাইডের ঘরে। ঘরে গিয়ে তল্পিতল্পা রেখে একে একে সবাই গোসল সারি। টিম মিটিংয়ে শনিবার সকালের পরিকল্পনা কষলাম। কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। ঘণ্টা খানেক পরে গাইডের ডাক, ‘দাদা, খাবার রেডি। খেতে আসেন।’
খাবার ঘরে গিয়ে দেখি, জুমের লাল চালের ভাত, আলু ভর্তা, ডিম ভাজি ও ডাল। এ ছাড়া ছিল পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খাবার নাপ্পি দিয়ে সবজি। তৃপ্তি নিয়ে পেটপুরে খেলাম। খাওয়ার পর্ব শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। অপেক্ষা সকাল হওয়ার অপেক্ষা, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার। অপেক্ষা, বিশাল লুং ফির ভা পাহাড়ি ঝর্ণার অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করার।