চাঁদপুরে লঞ্চ ভ্রমণ
শহুরে মানুষের হাতে সময় কম। দিন থেকে রাত ব্যস্ততার মধ্যে যেখানে দম ফেলার মুহূর্তগুলোও ঠিকমতো পাওয়া যায় না, সেখানে কোথাও ঘুরে বেড়ানোর সময় বের করা এক ধরনের বিলাসিতাই বটে কিছু কিছু মানুষের জন্য। তাই হয়তো ভ্রমণবিলাসী এক বিশাল মন থাকা সত্ত্বেও আপনার বেড়িয়ে আসা হচ্ছে না কোথাও। কক্সবাজারের সমুদ্রের গান শোনা আর বান্দরবানের কোনো পাহাড়ে উঠে মেঘ দেখার ইচ্ছাগুলোও তাই থেকে যাচ্ছে অপূর্ণ। কিন্তু ঘুরে বেড়ানোর মন ও দৃষ্টি থাকলে কম সময়ে এবং কম টাকায়ও চাইলে আপনি দারুণ কিছু মুহূর্ত লুফে নিতে পারেন আপনার শহুরে জীবনের আশপাশ থেকেই। ঢাকার ভ্রমণপ্রেমী ব্যস্ত মানুষ, যাঁরা সময়ের অভাবে দূরে কোথাও যেতে পারছেন না, তাঁদের জন্য ঢাকার আশপাশেই চমৎকার কিছু জায়গার বর্ণনা দেওয়া। একটু হাতে সময় নিয়ে আর পকেটে কিছু টাকা নিয়ে চাইলেই চমৎকার একটি ‘শর্ট ট্যুর’ দিয়ে আসতে পারেন। আজকে প্রথম পর্বে থাকছে ঢাকা থেকে চাঁদপুরের লঞ্চ ভ্রমণের কিছু তথ্য।
প্রথমেই ভাবতে পারেন, চাঁদপুর যখন যাবেনই, তাহলে সেটি লঞ্চেই কেন যেতে হবে? আসলে এই ট্যুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটি হচ্ছে এর যাত্রাপথ। দক্ষিণাঞ্চলের কিছু জেলার মানুষ ছাড়া শহরের খুব বেশি মানুষের আসলে নদীপথে চলাচলের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। আর বিভিন্ন সময়ের লঞ্চডুবির কিছু ঘটনা এবং ঈদের আগের খবরে সদরঘাটে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে লঞ্চ জার্নির ব্যাপারে ধারণাটাও একটু নেতিবাচক হয়ে গেছে কিছু মানুষের। তাই পারলে সদরঘাটে গা ভেড়ানোর কথা কেউ চিন্তাও করে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সদরঘাটে এখন এমন কিছু লঞ্চ রয়েছে, যেগুলোর আধুনিকতা আর বিলাসিতা দেখে আপনার চোখ কপাল ছুঁয়ে যাবে এবং সেগুলোতে চলাচল করাও বেশ নিরাপদ। তবে লঞ্চে ওঠার আগে শুধু একটু খোঁজ-খবর নিয়ে নেবেন, লঞ্চটি কেমন সে ব্যাপারে। আর জেনে নেবেন, দুর্ঘটনার সময় জীবন বাঁচানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কি না। চাঁদপুরে যাওয়ার জন্য সেরা দুটি লঞ্চ হচ্ছে রফরফ-২ ও ময়ূর-৭। এদের বাইরের ও ভেতরের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে এবং আপনি ভুলেই যাবেন যে এটি দেশের কোনো লঞ্চ! যদি চেয়ারে বসে যেতে চান, তাহলে ভাড়া লাগবে ১৩০ টাকা। আর সঙ্গে এসির বাতাস যোগ করতে চাইলে গুণে নিন ২২০ টাকা। কেবিনের ভেতর আরাম করেও যেতে পারেন চাইলে। ভাড়া : সিঙ্গেল কেবিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন এসি ৫০০ থেকে ৬০০, ডাবল কেবিন ৮০০, ফ্যামিলি কেবিন এক হাজার ১০০ ও ভিআইপি কেবিন দুই হাজার টাকা। ময়ূর-৭ ঢাকা থেকে ছাড়ে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে, চাঁদপুর থেকে রাত ১২টা ১৫ মিনিটে। রফরফ-২ ঢাকা থেকে রাত ১২টায় ও চাঁদপুর থেকে দুপুর ১২টায় ছাড়ে। এ ছাড়া আরো কিছু ভালো মানের লঞ্চ আছে। যেমন—এমভি তাকওয়া, এমভি সোনার তরী, এমভি মেঘনা রানী, এমভি বোগদাদীয়া, এমভি ঈগল, এমভি আল বোরাক, এমভি তুতুল ইত্যাদি। এগুলোর মানও খারাপ নয়। ভাড়াও প্রায় একই রকম। তবে একটু কমবেশি হতেই পারে।
আপনার ট্যুরটি সাজান মনের মতো করে। চাইলে দিনে গিয়ে দিনের মাঝে ফিরে আসতে পারেন। রাত করলেও ঝামেলা নেই। আবার রাতে জার্নি করে চাঁদপুর পৌঁছে পরের দিন ফেরার রাস্তায় যাত্রা করতে পারেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাতে ও দিনে দুই সময়েই লঞ্চের জার্নি খুব রোমাঞ্চকর। তাই এমনভাবে সফরসূচি তৈরি করুন, যাতে রাত-দিন মিলিয়ে প্রকৃতি-রূপের ষোলোআনাই পকেটে পুরে বাড়ি ফেরা যায়।
আপনার লঞ্চ জার্নি শুরু হবে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে। আস্তে আস্তে ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যা পাশ কাটিয়ে লঞ্চ গিয়ে উঠবে মেঘনায়। সবচেয়ে মুগ্ধ করবে যে ব্যাপারটা তা হলো, প্রতিটি নদীরই নিজ নিজ আলাদা রূপ আছে, যেটি হয়তো আগে কখনো খেয়াল করেননি। কেবিনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে না ঘুমিয়ে তাই উঠে যান ছাদে। চাঁদপুর পথের চারটি ঘণ্টা অসাধারণ কাটবে নদী, পানি, নৌকা, দূরের জনপদ আর জেলেদের মাছ ধরা দেখে।
মেঘনার ছোট ছোট জেলে নৌকা নদীর ঢেউয়ে দুলুদুলু দুলছে, মনে হচ্ছে এই তো বুঝি উল্টে গেল, কেউ বা ধরেছে জাল টেনে, শক্ত হাতে হাল টেনে ধরেছে তাঁর সঙ্গী, কেউ বা নৌকায় বসে গুনে নিচ্ছে ধরা পড়া মাছের সংখ্যা, কারো মুখের কোণে লেগে আছে হাসি, ওদিকে নৌকায় জীবন্ত ইলিশের ছটফটানি! এককথায় এক অপরূপ জীবনছবি। শহুরে জীবনের মায়া কাটিয়ে হয়তো কোনো জেলের ঘরে আশ্রয় নিতে চাইবে আপনার মন। থাক সে কথা! রাতে ফিরে আসার জার্নিটাও খারাপ হবে না। আর যদি জোছনা থাকে, তাহলে কথাই নেই। তবে শীতকালে আবার কুয়াশায় কিছু দেখতে পারবেন না। তাই রাতে ভ্রমণের জন্য পরিষ্কার আকাশ বেছে নিন। ঠান্ডা বাতাসের মাঝে চাঁদের আলো দেখতে দেখতে কীভাবে সময় কেটে যাবে, টেরই পাবেন না!
চাঁদপুরে নেমে কিছু ঘণ্টা হাতে রেখে একটু ঘুরে নিতে পারেন আশপাশ। দেখার মতো জায়গার অভাব নেই। আর চাঁদপুরে এসে ইলিশ না খেয়ে বাড়ি ফেরার মতো বোকামি করবেন না। যদিও এখন আসল চাঁদপুরের ইলিশ খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। তবে ভাগ্যে থাকলে হয়তো রুপালি ইলিশের স্বাদ নিতে পারবেন। লঞ্চঘাটের আশপাশেই বেশ কিছু রেস্তোরাঁ রয়েছে। চাইলে কালীবাড়ি মোড়ে গিয়েও খেতে পারেন। লঞ্চ জার্নির পর খাওয়াটা এককথায় অসাধারণ লাগবে।
সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরতে চাইলে মাঝে চাঁদপুর বড় স্টেশন মোহনা, (পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া), রক্তকরবী চত্বর, ইলিশ চত্বর, অঙ্গীকার স্বাধীনতা স্তম্ভ দেখে নিতে পারেন। আর একটু সময় হাতে থাকলে দেখতে পারেন লোহাগড়ের মঠ। তবে সেটি দেখতে চাইলে চাঁদপুর ঘাটে না নেমে এর পরে ইচলিতে নামুন। সেখানে নেমে সিএনজি একটি ভাড়া করে চলে যান লোহাগড়া মঠ দেখতে। যদি খুব ভোরে যেতে পারেন, তাহলে অসাধারণ লাগবে। উঁচু তিনটি মঠের ওপরে রয়েছে পাখির বাসা। ভোরে এদের বাড়ি ছাড়ার দৃশ্য পরিবেশটিকে আরো অসাধারণ করে তোলে। পাশের জলাভূমিতেও দেখা যাবে নাম-না-জানা আরো অনেক পাখি। অসাধারণ সুন্দর জায়গাটিতে যা দেখা যাবে তা আসলে আসল মঠের ধ্বংসাবশেষ। এই মঠগুলো ঘিরে নানা ধরনের গল্পও প্রচলিত আছে। স্থানীয় কারো কাছ থেকে সে গল্প শুনে নিতে ভুলবেন না। সিএনজি ভাড়া ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকার মতো লাগবে।