ঘোরাঘুরি
ঘুরে আসুন বালাপুর জমিদারবাড়ি, খরচ সাড়ে পাঁচশত টাকা
ঢাকার খুব কাছেই নরসিংদীর সদর উপজেলার পাইকারচর ইউনিয়নের মেঘনা নদীর তীরে বালাপুর গ্রামে প্রায় ৩২০ বিঘা জায়গার ওপর জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বালাপুর জমিদারবাড়ি। চমৎকার, দৃষ্টিনন্দন এবং মনোমুগ্ধকর কারুকার্য সমৃদ্ধ এই বাড়িটি ঘুরে আসতে পারেন যেকোনো ছুটির দিনে। আর পরিবার বন্ধুবান্ধবসহ ঘুরে আসতে পারেন আপনি মেঘনা নদীর তীরেও। চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে। বালাপুর জমিদারবাড়ির ভবনগুলোর চমৎকার কারুকাজ অত্যন্ত সুনিপুণ নির্মাণ শৈলীতে তৈরি যা শত শত বছর পরও আপনাকে মুগ্ধ করবে।
স্থাপত্যকলার দৃষ্টিনন্দন এক নিদর্শন ইতিহাস আর ঐতিহ্যে সৌন্দর্যমণ্ডিত বালাপুর জমিদারবাড়ি। বালাপুর জমিদারবাড়ির এই প্রাচীন ঐতিহ্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন। তাই আপনি চাইলে ঐতিহ্যবাহী বালাপুর জমিদারবাড়ি দেখে একই সঙ্গে আশপাশে আরো ঘুরে দেখতে পারেন পাঁচদোনায় পবিত্র আল-কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের বাড়ি, পারুলিয়ার ঐতিহাসিক পারুলিয়া মসজিদ এবং নরসিংদীর ডাংগার চমৎকার কারুকাজ সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী জমিদার লক্ষন সাহার বাড়ি এবং আশপাশের কিছু পোড়াবাড়ি। জমিদারবাড়িগুলোর নান্দনিক সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশৈলী আপনার কাছে হতে পারে এক অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
কে এই নবীন চন্দ্র সাহা
ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী বালাপুর জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এবং অত্র অঞ্চলের প্রধান জমিদার। জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা সেই সময় প্রায় ৩২০ বিঘা জায়গার ওপর অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এবং বিশাল আকারের এই বিলাসবহুল জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। এই বিলাসবহুল নান্দনিক কারুকাজ সমৃদ্ধ জমিদারবাড়ির ভবনটিতে ১০৩টি কক্ষ ছিল। সেই সময় যার প্রতিটি কক্ষেই মোজাইক করা ছিল। দরজা, জানালাগুলো ছিল ফুল লতাপাতাসহ বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর কারুকার্যে খচিত। ভবনটির পূর্বদিকে তিনতলা, উত্তর দিকে একতলা, দক্ষিণে দ্বিতীয় তলা এবং পশ্চিম দিকে একটি বিশাল আকারের গেটসহ দ্বিতীয়তলা রয়েছে। প্রতিটি ভবনেই ছিল মনোমুগ্ধকর কারুকার্যপূর্ণ।
জমিদার বাড়ির পশ্চিমে রয়েছে পুকুর, সান বাঁধানো পুকুরঘাট, উত্তরে দিকে রয়েছে কারুকার্য সমৃদ্ধ দুর্গাপূজার মণ্ডপ। দুর্গাপূজার মণ্ডপের ভিতরের কারুকাজ দেখে জমিদারবাড়ির অতীত ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে উঠে, জমিদারবাড়িতে সেই সময় অতিথিদের থাকা-খাওয়া ও ঘুমানোর জন্য ছিল আরো একটি সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন ভবন। জমিদারবাড়ির পাশেই রয়েছে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বালাপুর নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় এবং স্কুলের সামনে রয়েছে একটি বিশাল আকারের খেলার মাঠ। এ বাড়ি থেকে কিছু দূরে মেঘনা নদীর তীরে আরো একটি কারুকার্য খচিত একতলা বিশিষ্ট বিশাল দালান ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে সেই ভবন আর অবশিষ্ট নেই। এলাকাবাসীর মুখে শোনা যায় ভারতের কলকাতা থেকে স্টিমার এসে এখানে মালামাল খালাস করত। এই জায়গাকে বর্তমানে সবাই স্টিমারঘাট নামে চিনে এবং জানে।
জমিদার নবীন চন্দ্র সাহার ছিল তিন ছেলে। তাদের নাম কালীমোহন সাহা (জমিদার কালীবাবু), আশুতোষ সাহা, মনোরঞ্জন সাহা, এদের মধ্যে জমিদার কালীমোহন সাহা ছিল জমিদার নবীন চন্দ্র সাহার পরে পরিবারের প্রধান। জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা মারা যাওয়ার পর কালীমোহন সাহা (কালীবাবু) জমিদার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
জমিদারবাড়ির বর্তমান অবস্থা
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জমিদার কালীমোহন সাহা (কালীবাবু) সপরিবারে ভারতে চলে যান। জমিদার কালীবাবু ভারতে চলে যাওয়ার সময় আগে থেকে তাঁদের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাদের এই বিশাল সম্পত্তি ও জমিদারবাড়ির দেখাশোনার জন্য নির্দেশ এবং দায়িত্ব দিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে জমিদার কালীমোহন সাহা (কালীবাবু) এবং তাঁদের বংশধররা বাংলাদেশে আর ফিরে না আসায় জমিদার কালীবাবু যাঁদের জমিদারবাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা নতুন করে কাগজপত্র তৈরি করে এই বিপুল সম্পত্তি ভোগ দখল করতে থাকেন। দৃষ্টিনন্দন এবং সুন্দর বালাপুর জমিদারবাড়ির ভবনগুলোর মধ্যে অনেক ভবন ইতিমধ্যে সংস্কারের অভাবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বালাপুর জমিদারদের সোনালি অতীত ইতিহাস। অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য সৃষ্টি মনোমুগ্ধকর কারুকাজ সমৃদ্ধ জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা এবং জমিদার কালীমোহন সাহার এই ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ি আজও তাদের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ঐতিহ্যপ্রেমী এবং ভ্রমণ পিপাসু মানুষ শত শত বছর পর ও বালাপুর জমিদারবাড়ির বিশালতা এবং কারুকাজ দেখে অবাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে এবং মুগ্ধ হয়।
খরচাপাতি এবং যেভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে নরসিংদীগামী মেঘালয় বাস কাউন্টার আছে। মেঘালয় বাসে করে নরসিংদীর মাধবদী নামবেন, ভাড়া নেবে ৯০ টাকা আর লোকাল বাসে করে গেলে ৩০-৪০ টাকা। মাধবদী বাস স্ট্যান্ড নেমে রিকশায় করে যাবেন মাধবদী গরুরহাট সিএনজি স্টেশন ভাড়া নিবে ১০-১৫ টাকা তারপর গরুরহাট সিএনজি স্টেশন থেকে বালাপুরের সিএনজিতে উঠবেন, ভাড়া নিবে ২০ টাকা। সিএনজি বালাপুর নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নামিয়ে দিবে তারপর ২-৩ মিনিট হাঁটলেই ঐতিহ্যবাহী বালাপুর জমিদারবাড়ি। ঢাকা থেকে বালাপুর জমিদারবাড়িতে দিনে গিয়ে দিনেই খুব সুন্দরভাবে সহজেই ঘুরে আসা যায় তাই নরসিংদী বা মাধবদীতে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। বালাপুর জমিদারবাড়ি ঘুরে দেখে এসে নরসিংদীর মাধবদীতে খেতে পারেন এখানে মোটামুটি মানের কয়েকটা ভালো খাবার হোটেল আছে। ভাত-সবজি-মুরগির মাংস-খাসির মাংস-বিভিন্ন মাছ-ডাল অথবা বিরিয়ানি। দুপুরের খাওয়া বাবদ খরচ হবে ১২০ থেকে ১৬০ টাকা। সব মিলিয়ে ৪৫০-৫৫০ টাকায় ভালোভাবেই ঘুরে আসা সম্ভব। আর কেউ যদি একদম ব্যাকপ্যাকিং ট্যুর করতে চায় তাহলে ২০০-২৫০ টাকায় ঘুরে আসা সম্ভব।