ঈদের ছুটিতে
দুই ঘণ্টায় ৩০০ টাকায় রাজাহীন রাজবাড়িতে
জীবনের ব্যস্ততার সীমারেখা পেরিয়ে সবাই চায় কিছুটা সময় ভিন্ন জগতে কাটাতে। তবে এখানেও কথা আছে, সময় ও আর্থিক ব্যাপারটাও ভেবে দেখতে হয়। যাদের পুরোনো দিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আগ্রহ আছে, তাদের জন্য রাজবাড়ী ভ্রমণ অন্য মানে বয়ে আনে। সেসব ভ্রমণপিয়াসী মানুষের জন্য মুক্তাগাছা জমিদারি দর্শনীয় স্থান। ঢাকা শহর থেকে দুই ঘণ্টার পথ আর খরচ মাত্র ৩০০ টাকা মাত্রা। আর দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে পারবেন। তবে আর দেরি কেন...
ইতিহাস
মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। অথচ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী সম্পত্তি সংরক্ষণে সক্ষম একটি পুত্রসন্তান ভীষণভাবে প্রয়োজন। কী করা যায়? জীবনের জটিল অঙ্ক কষতে কষতে দত্তক পুত্র গ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তিনি। হ্যাঁ, গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিলেন রঘুনন্দন। সময়ের এক বিশেষ লগ্নে দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পাড়ি জমালেন পরপারে। জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রতিও সদয় ছিল না নিয়তি! সন্তানহীন অবস্থায় অকালপ্রয়াণ ঘটল তাঁরও! গৌরীকান্তের বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিল ভীষণ। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করলেন তিনিও। তাঁর বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত ত্যাগ করলেন পৃথিবীর মায়া। তবে হাল ছাড়লেন না লক্ষ্মী দেবী। পুনরায় দত্তক নিলেন তিনি। দ্বিতীয় দত্তক পুত্রের পূর্বনাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। কূলগুরুর সামনে মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী নতুন নাম রাখলেন পুত্রের—সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো সোনালি মাত্রা । প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করলেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশী লজ।
যা দেখবেন
শান বাঁধানো প্রবেশপথের সামনেই শশী লজের সাজানো বাগান। বিচিত্র প্রজাতির ফুল শোভিত সেই বাগানের মধ্যভাগে বৃত্তাকার জলফোয়ারা। ফোয়ারার কেন্দ্রস্থলে অনুচ্চ বেদির ওপর দণ্ডায়মান গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত স্বল্পবসনা নারীর মর্মর মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ। ভবনের মূল ফটকে আছে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরের প্রায় ৩৬টি ঘরের প্রতিটিতেই আছে ঝাড়বাতি। ভবনের ভেতরে আছে মার্বেল পাথরের ফোয়ারা। দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গমগাছ ছিল, যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভবনের পেছন দিকে রয়েছে গোসলের জন্য দোতলা গোসলখানা। ধারণা করা হয়, এখানে বসেই রানি পাশের পুকুরে ভেসে বেড়ানো হাঁসের খেলা দেখতেন। পুকুরঘাটটি ছিল মার্বেল পাথরের। ভবনের সামনে বাগানের মাঝখানে আরেকটি শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। সুপ্রাচীন এই ভবনের পূর্বপ্রান্তের ঘরটি বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে। বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের একপ্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো স্ফটিকস্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি।
আরো যা দেখবেন
লাল ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজের পাশেই আছে পদ্মবাগান। বাড়িটিতে বেশ কিছু স্নানঘর রয়েছে। এক স্নানঘরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। ধারণা করা হয়, এই সুড়ঙ্গপথেই গোপনে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। উল্লেখ্য, মুক্তাগাছার জমিদারবাড়িতেও এ রকম একটি সুড়ঙ্গপথ পাওয়া যায়। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠান পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক ‘অয়োময়’-এর পর্বগুলো এখানে ধারণ করা হয়। এ ছাড়া ‘রাখাল বন্ধু’ নামে আরেকটি ধারাবাহিক নাটকের শুটিংও এই বাড়িতে হয়েছিল। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায় নেওয়ার পালা চলে এলো। আমরা ফিরে চললাম আমাদের গন্তব্যে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশে সৌখিন, এনা, নিরাপদ বাস ছেড়ে আসে। টিকেটের মূল্য ২২০ টাকা। সময় লাগবে দুই ঘণ্টা অথবা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহে ঘুরে আবার ৫টা ২০ মিনিটের ট্রেনে ফিরে যেতে পারেন ঢাকায়। ট্রেনের ভাড়া ১২০ থেকে ২৫০ টাকা। এর পর মাসকান্দা বাস টার্মিনাল অথবা স্টেশন থেকে রিকশা, অটোরিকশাযোগে যাওয়া যায় অথবা ব্রিজ হতে রিকশা, অটোরিকশা, টেম্পোযোগে যাওয়া যায় শশী লজে। বলে রাখা ভালো, শশী লজ রোববার পূর্ণ দিবস এবং সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে।