ছুটির দিনে
শিমুল বন
এ যেনো কল্পনার রঙে সাজানো এক শিমুলের প্রান্তর। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে যাদুকাটা নদী আর এপাড়ে শিমুলবন। সব মিলে মিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে শিমুলবন তার সৌন্দর্য্যের ডালি মেলে ধরে তখন। সোনালি আলোতে লাল টকটকে ফুল এক মোহনীয় আবেশ তৈরি করে। এই দৃশ্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে শীতের শেষ দিকে, ফেব্রুয়ারি মাসে।
শিমুল বন নিয়ে কথকতা
১৫ বছর আগে দুই হাজার ৪০০ শতক জমিতে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন, জয়নাল আবেদীন। মাত্র ১২ বছর বয়সে জয়নাল আবেদীন তাঁর পরিবারের সবার সঙ্গে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন । কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উদ্যমী। সংগ্রামমুখর জীবনে অল্প বয়সেই ইতি টানেন পড়ালেখার। নানা পেশা বদলে একসময় জড়িয়ে পড়েন মৎস্য ব্যবসায়। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইনল্যান্ড ফিশারিজের মাধ্যমে ইজারা নেন টাঙ্গুয়ার হাওর। আবার বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। কিন্তু শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে মন ভরল না তাঁর, ইচ্ছে আরো কিছু করার। যা মানুষের কল্যাণে আসবে। গাছপালার প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম মমতা। গাছ লাগাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর এই পছন্দের সঙ্গে একাত্ম হলো তাহিরপুরের সাধারণ মানুষের ভাবনা।
হাওরাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন কয়েকটি গুরুতর সমস্যায়। বর্ষা এলেই আমূল বদলে যায় এখানকার দৃশ্যপট। ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙতে থাকে পাড়। হাওরের আশপাশে যে ক’টি বাড়িঘর আছে সেগুলোও ঢেউয়ের তোড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। এমন গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষই ঠিক করে নিল তাদের করণীয়। শক্ত শিকড় বাকড়ের জলসহিষ্ণু গাছপালাই এর একমাত্র সমাধান। সংখ্যায় কম হলেও এমন দু-একটি প্রজাতি সেখানে আগে থেকেই ছিল। যার অন্যতম হিজল এবং করচ। গলা সমান পানিতেও এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। কিছু দিন পর স্থানীয়দের এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি নতুন মাত্রা। এসব গাছের একাধিক উপযোগিতার মধ্যে তারা জ্বালানি সংগ্রহের গুরুত্বও উপলব্ধি করতে পারল। শুধু হিজল ও করচ লাগালেই একসঙ্গে অনেক সমস্যার সমাধান মিলবে। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরুটা কীভাবে, আর করবেই বা কে? স্থানীয় মানুষ যখন এসব নিয়ে ভাবছিল তখন অনেকটা পরিত্রাতা হিসেবেই আবির্ভূত হলেন বাদাঘাট ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তিনি ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় ৯০ হাজার করচ গাছ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি হিজল গাছও লাগিয়েছিলেন বেশ কিছু। চারাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয়ভাবেই। শুধু গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। গাছের পুরো যত্ন -আত্তির দায়িত্বও নিজের কাঁধে নেন। শুঁকনো মৌসুমে নিজেই গাছে পানি দিতেন। একটানা ১৩ বছর তিনি সত্যিকার অর্থেই অসাধ্য সাধন করেছেন। টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে দু’পাশে চোখে রাখলে যে কারোই মনে প্রশ্ন জাগবে, এমন বিচ্ছিন্ন জনপদে কোথা থেকে এলো এত গাছ? কিন্তু তিনি আজ নেই। পৃথিবীর মোহমায়া ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছেন জয়নাল আবেদীন। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর অনন্য কীর্তি। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওরজুড়ে তাঁর সন্তানসম বৃক্ষগুলো এখন প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে করে ট্রেনে চলে যান সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের নতুন ব্রিজের গোড়া থেকে বাইক অথবা লেগুনায় সরাসরি লাউড়ের গড় চলে যেতে পারবেন। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা ও লেগুনা এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা রিজার্ভ। চাইলে প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও চলে যেতে পারেন লাউড়ের গড়। তারপর বালুচর দিয়ে হেঁটে চলে যান শিমুল বন।