সান্দাকুফু সিরিজ-১
টংলু ভ্যালির প্রেমে
যারা পাহাড় আর ট্রেকিং ভালোবাসেন, দার্জিলিং জেলার সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ফুট উচ্চতার সান্দাকুফু ট্রেক তাদের অনেকের কাছেই দারুণ একটা চ্যালেঞ্জ। অনেক স্বপ্নের একটা ট্রেক। আর এই ট্রেকের অন্যতম আকর্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘার অপার্থিব সম্মোহন পেতে, পথে যেতে আরো কয়েকটি আকর্ষণীয় ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম বা পাড়া পাড়ি দিতে হয়, যার মধ্যে একটা হলো টংলু।
টংলুতে দুইভাবে যাওয়া যায়। মানেভাঞ্জন থেকে ট্রেক করে বা জিপে করে অথবা মানেভাঞ্জন থেকে আরো সামনে ধোত্রে পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে ট্রেক করে। ধোত্রেতে একটি ম্যাপ আর সাইনবোর্ডে লেখা আছে সান্দাকুফু/টংলু এই দিকে... ধোত্রে থেকে টংলু ৪ কিলোমিটার ট্রেক। দুই পাশে ছোট ছোট পাহাড়ি বর্ণিল ঘরবাড়ির ঝলমলে উপস্থিতি। পাহাড়ের রিজ ধরে যেন গড়ে তোলা হয়েছে সেগুলো, দুই পাশের বাড়িগুলোর বারান্দাই হলো ট্রেক রুট। খুব ধীরলয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। এরপর আবার নেমে গেছে আকাশের সাথে মিশে থাকা অরণ্যর গভীরে। সে এক অদ্ভুত সমীকরণ আকাশ আর অরণ্যর। যেন দুজনে যুক্তি করে মিলেছে দুজনের সাথে।
পাহাড়ি বাড়িঘরের বারান্দার সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নামতেই একেবারে সমতলে গিয়ে পৌঁছাবেন আর ঠিক সেখানেই যে অরণ্যর শুরু সেটাই সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক। দেখেই একটা বিদ্যুৎ চমক খেলে যাবে মনে-প্রাণে। যদি থাকে অনেক দিনের স্বপ্ন আর সাধনা এই গভীর অরণ্যর স্বাদ নেবেন বলে। যদি ছবি এঁকে থাকেন, কল্পনা করে থাকেন, দেখে থাকেন স্বপ্ন। আর আজ সেই অরণ্য, সত্যিকারের সিঙ্গালিলার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। এই কথা ভাবতেই যেন নতুন উদ্যম পেয়ে যাবেন নিজের মাঝে।
একটু এগোতেই পেয়ে যাবেন এক দারুণ সবুজের মখমলে মোড়ানো মিহি ঘাসের কয়েকটি টিলা। সেই অরণ্যর মাঝেই। এখানে একটু না বসলেই নয়। একটু বিশ্রামের পরে আবার শুরু করুণ স্বপ্নারণ্যে পথ ধরে স্বপ্নের শেষ সীমানায় যাওয়ার হাঁটা। দু-একটি ছোট ছোট পাহাড় পার হয়ে আরেকটু উঁচু পাহাড়েই নিজেদের আবিষ্কার করবেন অনেক ছবি দেখা, গল্প পড়া আর একদিন ছুঁয়ে দেখবেন বলে ভেবে রাখা রডেনড্রনে বেষ্টিত পাহাড়ের সারি।
আর একেকটা রডেনড্রন গাছে ধরে আছে একেক রকমের ফুলের কুঁড়ি। নাহ ফুল নেই একটুও প্রস্ফুটিত। যা আছে সব কুঁড়ি। কারণ ফুলের সময় এই অক্টোবর নয়। সেই খেলা দেখতে হলে যেতে হবে কোনো এক এপ্রিলে। তবে পাহাড়ে পাহাড়ে, রডেনড্রনের আশপাশে, সবুজের গালিচা ছুড়ে ফুটেছিল নাম না জানা শত রকম আর রঙের ফুল।
পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে, একটা সমতল ভ্যালির মতো পাবেন, যেখানে আবার বিশ্রাম। পুরো ভ্যালিটাই অদ্ভুত রকমের সমতল, যার চারদিকেই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘিরে ধরা, কাছে বা দূরে। বেশ কিছু হলুদাভ ঘাস বা নাম না জানা কোনো ফসলের গাছ পুরো ভ্যালিজুড়েই। সামনে তিনটা পাহাড়ের পরে যে চূড়াটা দেখা যাচ্ছে, ওটাই টংলু।
তিনটি পাহাড় পেরিয়ে আরেকটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেই টংলু। ১৫ মিনিট হবে হয়তো, পৌঁছে যাবেন টংলুতে। ওঠার পরে দেখবেন এটা কোনো চূড়া নয়, একেবারেই সমতল টেবিলের মতো এক ভ্যালি আবার। যেটা স্নিগ্ধ সবুজের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এর উচ্চতা প্রায় নয় হাজার ফুটের কাছাকাছি। এত উঁচু পাহাড়েও যে ভ্যালির মতো সমতল হতে পারে ভাবতেই পারিনি। একটু এদিক সেদিক তাকিয়ে, হেঁটে দেখে বোঝা গেল যে এটা আসলেই এক পাহাড়ের চূড়া। কিন্তু অনেক বড় একটি পাহাড়ের অনেকটা বিস্মৃত এই চূড়া তাই অনেকটা ভ্যালির মতো লাগছে।
আর যে বাড়ি বা ঘরে বসে বিশ্রাম নেবেন। সেটা তো যে স্বর্গ থেকে তুলে এনে এই পাহাড়ের চূড়ায় বসিয়ে রেখেছে স্বয়ং বিধাতা যেন! এতটাই নান্দনিক আর অপূর্ব সাজে সেজে অভিবাদন জানাবে আপনাকে। কত রকমের আর রঙের ফুল যে ফুটে ছিল সেই বাড়িটির পুরো বেলকনিজুড়ে... আর ছোট্ট বাঁশের বেড়া দেওয়া উঠোন তো যেন একটুকরো সবুজ, স্বচ্ছ আর ঝকঝকে বিছানা। যেখানে পা রাখতেও শঙ্কা হয়, পাছে অভিমান করে ওর নিষ্পাপ শরীরে রেখেছি আমাদের ময়লা পা! এতটাই মিহি আর মায়ামাখা ছিল টংলুর সেই সবুজ চাদর বিছানো মুগ্ধ উঠোন।
আপনি পুরোপুরি প্রেমে পড়ে যাবেন টংলুর। ভালোবেসে ফেলবেন টংলুকে। ইচ্ছে হলে থেকে যেতে পারেন একটি দিন আর তার এই টংলুতেই।
ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে মানেভাঞ্জন বা দার্জিলিং হয়ে মানেভাঞ্জন থেকে জিপ বা ট্রেক করে যাওয়া যায় টংলু। থাকা যায় গ্রাম্য কটেজে ২০০-২৫০ রুপি জনপ্রতি। খাবার ১৩০-১৫০ রুপি প্রতি বেলা।