নজরুলের জন্মভিটায়
‘কবিতীর্থে’ একদিন
কেন যাবেন?
ভ্রমণ যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের সবার কাছেই প্রথম পছন্দ পাহাড় বা সমুদ্র। সময়, সুযোগ আর সাধ্যে মিলে গেলেই কেউ ছুটে যায় সবুজ বা সাদা পাহাড়ে। আবার কেউ নীল সমুদ্রের ধূসর বিচে। তবে এই দুটোর যেকোনোটিতে যেতে সাধ, সময়, আর সাধ্যের সম্মিলন ঘটতে হয়। এর বাইরেও অনেকেই নতুন কোনো গ্রাম বা ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করে থাকেন।
যেখানে একই সঙ্গে আছে গ্রামীণ নিস্তব্ধতা, মানুষের সান্নিধ্য। বলছিলাম আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান বা গ্রামের বাড়ি, আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামের কথা। যেটা এখনো সেই ১৮৯৯ সালের প্রাচীন গ্রামই রয়ে গেছে। দু-একটি ইটের বদল ছাড়া তেমন কিছু বদলেছে বলে মনে হয়নি। কবি নজরুলের জন্মভিটা আসানসোলের, চুরুলিয়া গ্রামটি এখন অনেকের কাছেই ‘কবিতীর্থ’ নামে পরিচিত।
কী কী দেখবেন?
কয়েকটি কারণে কবিতীর্থ চুরুলিয়ায় যেতে পারেন। যাঁরা ভালোবাসেন কোনো গ্রাম, প্রাচীন ঘরবাড়ি, ভালোবাসেন ঐতিহাসিক স্থান—তাঁরা নিঃসন্দেহে আর নির্দ্বিধায় দু-একদিনের জন্য অল্প খরচে দেখে আসতে পারেন কবি নজরুলের এই জন্মস্থান। ঘুরে আসতে পারেন আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে। তাতে করে অবহেলিত আর দরিদ্র নজরুলের প্রতি কিছুটা দায় মেটানোর সুযোগও পাওয়া যেতে পারে।
কবিতীর্থে গেলে দেখতে পাবেন সেই দুই শতক আগের ইট, পাথর আর কাঠের ঘরবাড়ি। বারান্দা, ছাদ, কার্নিশ, ব্যালকনি যেন হুবহু রয়ে গেছে আগের মতই। শুধু খসে গেছে পলেস্তারা, ভেঙে গেছে বারান্দার চৌকাঠ, বেরিয়ে গেছে লোহার কার্নিশ। জ্বলে গেছে পুরোনো দেয়ালের রং, ধসে গেছে লোহার গেট, ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে। সেই আমলের কল থেকে জলের ধারা, বয়ে চলেছে ক্ষীণ নদী, দাঁড়িয়ে আছে ধূসর-কালো পাহাড়ের সারি। কবি যে চুরুলিয়া বাজারে রুটির দোকানে কাজ করতেন, সেই ভঙ্গুর আর ভীষণ দরিদ্র, কোলাহলহীন একটি বাজার।
যা কিছু আপনাকে স্পর্শ করবে
বাজার থেকে কয়েক মিনিট সামনে এগোলেই চোখে পড়বে কবির জন্মভিটা। যেটা এখন আর সনের ঘর নেই, আজকাল ছনের ঘরের পরিবর্তে একটা হলুদ ইট-পাথর আর কাঠের অবকাঠামো। প্রায় তিনতলা বাড়ি, যেটা এখন নজরুল একাডেমি নামে পরিচিত। নিচের রয়েছে কবির ব্যবহার করা ঘর, বারান্দা আর ছোট্ট অফিসঘর। পাশের লাগোয়া একতলা বাড়ির সবটুকু জুড়ে, নজরুল মিউজিয়াম বা কবির ব্যবহার করা নানা রকম ফার্নিচার, কবির নিজের হাতের লেখা নানা রকম পাণ্ডুলিপি, প্রথম প্রকাশিত নানা রকম কবিতা, গল্প বা গানের পত্রিকার সংরক্ষিত কপি। কবির জীবনের বাঁক নেওয়া নানা রকম ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। কবির ছেলেবেলা থেকে শেষবেলা পর্যন্ত নানা ঘটনার বর্ণনা। এর পাশেই রয়েছে লাইব্রেরি।
একটু সামনে এগোলেই কবির প্রথম পাঠ সেখার মক্তব বা মসজিদ। কথিত আছে, যেখানে কবি প্রথম মুয়াজ্জিন ছিলেন। মসজিদের সঙ্গেই লাগোয়া বেশ বড়সড় একটি পুকুর, যেন ইতিহাসকে ধরে রেখেছে আগের মতই। যেখানে কবি সাঁতার শিখেছেন, গোসল করেছেন। পাশেই কবির প্রথম স্কুল, যে স্কুলে এককালে কিছুদিন পাঠদান করিয়েছেন বলেই জনশ্রুতি আছে। স্কুল প্রাঙ্গণের খোলা জায়গায় ঘেরা দিয়ে রাখা হয়েছে কবির সহধর্মিণী আর পুত্রের সমাধি। যেখানে কবির পূর্ণ এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গাটার একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আছে। গাছের ছায়া ঘেরা সমাধিতে একটা ঝিরঝিরে প্রশান্তির বাতাস যেন বয়ে যায় সব সময়। আর একটু সামনে এগোলেই আছে নজরুল যুব ইনস্টিটিউট। একটি বেশ বড় তিনতলা ভবন। মেলা বা উৎসব উপলক্ষে এখানে আগত অতিথিদের থাকার জন্য হোস্টেল। বাইরের লোকজনও থাকতে পারে, অনলাইনে বুকিং দিয়ে গেলে। মোটামুটি একবেলাতেই নজরুলের জন্ম সৃতিবিজড়িত আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রাম দেখা হয়ে যাবে অনায়াসে।
যাওয়া-আসা
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে কলকাতা। কলকাতার শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে প্রতি ঘণ্টায় ছেড়ে যায় কোনো না কোনো ট্রেন। যেগুলো আসানসোলের ওপর দিয়েই যায় সাধারণত। সময় লাগে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা, ভাড়া নেমে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। আসানসোল স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল মিনিবাস ছেড়ে যায় চুরুলিয়ার দিকে, সময় লাগে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ভাড়া ২০-৩০ টাকা। তবে গ্রুপ করে গেলে আসানসোল স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডের পাশ থেকে ট্যাক্সিও রিজার্ভ করতে পারেন। ভাড়া পড়বে ১০০০-১৫০০ টাকা। ফেরার পথটাও একই রকম করা যেতে পারে। বাস বা ট্রেন কোনোটাই অপর্যাপ্ত নয়।
থাকা-খাওয়া
কবিতীর্থ চুরুলিয়ায় থাকার জায়গা বলতে নজরুল যুব কার্যালয়ের একটি ভবন, যেটা আগে থেকেই অনলাইনে বুকিং দিয়ে যেতে হয়, থাকা-খাওয়ার জন্য। তবে কেয়ারটেকারের উপস্থিতির ওপরে ভিত্তি করে গিয়েও থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন আলোচনা করে, সঙ্গে খাবার ব্যবস্থাও। আর খাবারের ক্ষেত্রে চুরুলিয়া বাজারে তেমন মানসম্মত খাবার হোটেল চোখে পড়েনি। স্থানীয় দু-একটি খুবই সাধারণ মানের হোটেল ছাড়া। তবে থাকা-খাওয়ার ক্ষেত্রে আসানসোলই সবচেয়ে উপযুক্ত আর আরামদায়ক। আসানসোলেই পাবেন বেশ ভালো মানের হোটেল ৫০০-২০০০ টাকার মধ্যে। খাওয়ার জন্য নিজের পছন্দ, রুচি, স্বাদ আর সাধ্যমতো সবকিছুই। আর থাকতে না চাইলে সাড়ে চার ঘণ্টার ট্রেনে কলকাতায় ফিরেও আসতে পারেন।