ছুটির দিনে
জ-ত্লংও যোগীহাফং জয়
“ইচ্ছে তো হয় সারাটা জীবন
এই পৃথিবীকে
এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে যাই দুই
পায়ে হেঁটে হেঁটে
অথবা বিমানে”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছি দূর-বহুদূর। যেথায় আকাশ-মেঘ-পাহাড়-প্রকৃতি মিলে একাকার। এমন উদ্দেশ্যে গন্তব্য এবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা বান্দরবানের থানচিতে অবস্থিত উচ্চতায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত জ-ত্লং (মোদক মুয়াল) এবং চতুর্থ উচ্চতার পর্বত যোগীহাফং জয়।
একদল সাহসী, অনুসন্ধিৎসু, ভ্রমণপ্রিয় ও যাদের রক্তে মিশে আছে পাহাড় জয়ের কাব্য এমন ২৫ জন ট্রেকার নিয়ে ট্যুর গ্রুপ বিডি (টিজিবি) ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রওনা হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ৮ টায় পৌঁছায় দলিয়ানপাড়ায়। এর মধ্যে আছে ১২ ঘণ্টার ঢাকা-বান্দরবান বাসযাত্রা, বান্দরবান-থানচি তিন ঘন্টার চাঁদের গাড়ি, থানচি-রেমাক্রি ৩ ঘণ্টার সাঙ্গুতে নৌভ্রমণ এবং রেমাক্রি-দলিয়ানপাড়া চার ঘণ্টার পদযাত্রা।
জ-ত্লং:
জ-ত্লং বা মোদক মুয়াল, পর্বতটি অনেক ভ্রমণকারীর কাছে অপরিচিত হলেও পর্বতারোহীরা চিনে থাকেন এক নামে। কারণ আর কিছুই নয়, এর দুর্গমতা। অন্য যেকোনো পর্বত এমনকি সুউচ্চ সাকাহাফং-এর চেয়েও কঠিন এই পর্বতের চূড়ায় পৌঁছানো। তবে দুর্গমতাই এর প্রতি তৈরি করেছে মাদকতা। নাসার স্যাটেলাইট ডাটা থেকে দেখা যাওয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় চূড়া এটি। উচ্চতা ১,০১৪ মিটার বা ৩,৩২৮ ফুট।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষেই চারজন গাইডকে সঙ্গে করে গ্রুপ লিডার রাহি রাফসানের নেতৃত্বে জ-ত্লং অভিমুখে যাত্রা শুরু। সাথে আছে অভিযানের রসদ শুকনা খাবার, খেজুর, কিসমিস, সিদ্ধ ডিম, কলা, পানি। দলিয়ানপাড়া থেকে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট হাঁটার পরেই আসে ওয়াই জংশন। মূলত ওয়াই জংশন থেকে দুটি পথ দু’দিকে চলে গেছে। বাম পাশে যোগী ট্রেইল আর ডান পাশে দিয়ে জ-তলং ট্রেইল। গাইডের ভাষ্যমতে জ-ত্লং যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। কিন্তু রাস্তা দেখে এবং প্রতি কদমে কদমে বুঝা গেল কতটা অসাধ্য ব্যাপার। জ-ত্লং এর রাস্তা বড়ই কঠিন। বড় বড় পাথরের বোল্ডারের রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। সাথে আছে পাথরের পিচ্ছিল দিয়ে ৮০ ডিগ্রি উঁচু খাড়া পাহাড়ে ওঠা। কঠিন এই পথ পাড়ি দিতে ২৫ সদস্যের আহত হয়নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গাইড সিমপাদকে নিয়ে অগ্রভাগে ছিল সাকিব, বুনোফল, রিমন ও আমি। সকলের মনে ছিল সুপ্ত বাসনা ও তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কখন সে সময় আসবে, যখন চূড়ায় গিয়ে পতাকা সমেত হাওয়ায় ভাসব। একে একে উঁচু খাড়া পাহাড়, বাঁশঝাড় পাড়ি দিয়ে সকাল ১১.১০ এ পৌঁছে যাই জ-ত্লং চুড়ায়। ভিডিও বার্তায় প্রকাশ করি বিজয়োল্লাসের অভিব্যক্তি। একে একে সবাই সমবেত হয়। সর্বশেষ গ্রুপটি আসে ১.৩০-এর দিকে। সবার নাম লিখে পূর্বোস্থ স্থাপিত বোতলে জ-ত্লং চূড়াজয়ীদের তালিকায় নিজেদের নামও (সাকিব, সৈকত, বুনোফুল, রিমন, রাহী, খয়রুল, রানা , শিফন, রাজন, সায়েম, সেতু, আশিক, উপল, সুরমা, টুটুল, ফারজানা, জ্যোতি, নজরুল, সবুজ, নাসের, তাহিশীম, হাসান, শোয়েব, ওমর ও মুজতবা হাসনাত) গচ্ছিত রাখি।
এবার ফেরার পালা। গাইড পারদ দা যেহেতু বলেছিল পুরো পথটি মাত্র ৩ ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া সম্ভব সে কথাকে মাথায় রেখে সাকিব সমেত কোনোরকম বিরতি ছাড়াই দৌড়ে দৌড়ে আসি এবং সূর্যের আলো থাকতেই মাত্র ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যাই দলিয়ানপাড়ায়। পরের গ্রুপটি আসে রাত ৮টায় এবং সর্বশেষ গ্রুপটি আসে সিনিয়র ট্রেকার তহুরুল হাসান টুটুল ভাইয়ের নেতৃত্বে ১২.৩০ মিনিটে। সবার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করা কষ্টের এবং মধুর ছিল। একসাথে খেতে বসব ভেবে বসে থাকা কিন্তু একেকটি গ্রুপ একেক সময় এসে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্নণা দেয়। সাথে আছে কারো ঠোঁট কাটা, পা মচকে যাওয়া এবং ক্লান্ত হয়ে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসতে না চাওয়ার বর্ণনা। মোদ্দকথা কারোরই হাত, পা, শরীরের বিভিন্ন অংশ কাটাছিঁড়ার বাকি ছিল না। স্বয়ং গাইডও দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
যোগীহাফং:
বাংলাদেশের এ পর্যন্ত অভিযান হয়েছে এমন পাহাড়গুলোর মাঝে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ চুড়া যোগী হাফং তথা কংদুক। এর অবস্থান চতুর্থ এবং উচ্চতা ৯৮৩ মিটার বা ৩২২২ ফুট। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বেশ দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত মোদক রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত এই পাহাড়। স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে যেন বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে পার্থক্য একে দিয়েছে। যোগীর মূলত ৪টি চূড়া। আসলে সর্বোচ্চ চূড়া ১টি আর বাকি ৩টি সাব পিক। ৪র্থ চূড়াটি বেশ ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। এ জন্য অনেকে মিশন শেষ করতে পারেন না।
জ-ত্লং জয়ী হলেও যেহেতু অনেকের অবস্থা ছিল সূচনীয় সেহেতু ২৫ সদস্যের মাত্র ১০ জনসহ (রাহী, খয়রুল, রানা, রাজন, বুনোফুল, সায়েম, সেতু, আশিক, উপল ও সৈকত) গাইড মনোচিং ও চশেরাকে নিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টায় যোগীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। এদলের সবাই বেশ দক্ষ ছিল মাত্র ১ ঘণ্টায় ওয়াই জংশন পাড়ি দিয়ে যোগীর ট্রেইল ধরি। ঝিরিপথ ধরে শুরু মনে হল পাথরের রাজ্যে গমন করছি। ছোট-বড়-বিশালাকৃতির একেকটা পাথর। সাথে আছে ভয়ংকর বড় বড় গাছের দেয়াল শিকড়, এখানেও কয়েকটি উচু খাড়া জায়গায় উঠতে হয়েছে যা রশির সাহায্যে পাড়ি দিতে হয়েছে। পূর্বেই জানা ছিল পানির শেষ উৎস যোগীর অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। ভয় কাজ করছিল গাইড বুঝি বলে উঠে এই হচ্ছে পানির শেষ উৎস! পর্যাপ্ত পানি নিয়ে নিয়ে শেষ উৎস থেকে আরো ৪০ মিনিট হাঁটার পর ঝিরিপথ পর্বের সমাপ্তি ঘটল।
পাহাড় তটে কিছুটা বিশ্রাম ও সাথে গাইডের নির্দেশনা হচ্ছে এবার দু’ঘন্টা ধারাবাহিকভাবে উঁচু পাহাড়ে উঠতে হবে এবং একজন একজন করে। কোথাও বাঁশ ধরে কোথায় শেকড় ধরে। চারদিকে বাঁশ দিয়ে ফাঁদ পাতা আছে। একটু বেঠিক হলেই কারো পা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে যাবে। যতই উপরে অগ্রসরমান জ-ত্লং কে ততই কাছ থেকে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু যোগীর চূড়া দেখা মিলছিল না।
পাহাড়ে ওঠার সময় গাইডদের যখনি বলা হয় আর কত মিনিট লাগবে সে ১০ মিনিটের কথা বলে ২ ঘণ্টা হাঁটার পরও বলবে এইত আর ৫ মিনিট। সেই ৫ মিনিট আর শেষ হয় না। ধীরে ধীরে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত শরীরে আগাতে থাকি। কারণ জানি এসব কষ্ট পাহাড় জয়ে এক নিমেষেই বিলীন হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পর পরই বিরতি দিচ্ছিলাম। এমনি একবার বিরতিতে যাব ভেবে যেই বসতে যাচ্ছিলাম এমন সময় গাইড জানাল এইত পাশেই প্রথম চূড়া। আনন্দে দিশেহারা প্রায়। চূড়াটিতে দুজনের বেশি ওঠা যাচ্ছিল না। রানা ভাই সমেত উঠে চারদিকের অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করে পাহাড়ের বুকে নিজের কণ্ঠকে ছুড়ে দিই। আওয়াজ ফিরে আসে অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করে।
প্রথম চূড়ার নিচেই সবার জন্য অপেক্ষা করি। একে একে সবাই এসে শীর্ষে আরোহণ করে। সবার চোখে মুখে সেই কি খুশির ঝলক। একটু বিরতি দিয়ে ১৫ মিনিটের মতো আগালেই দ্বিতীয় চূড়া এবং সামনে আরো পাঁচ মিনিট আগালেই তৃতীয় চূড়া। এখানেও কয়েকটি ফটোশেসন করে এবার উদ্দেশ্য চতুর্থ তথা সর্বোচ্চ চূড়া।
দুরন্ত গতিতে সর্বোচ্চ চূড়ার দিকে যাচ্ছিলাম। প্রায় ২৫ মিনিটে হাঁটার পর চূড়ার দেখা পেলাম। কিন্তু হঠাৎ চমকে উঠলাম সামনের রাস্তা দেখে। কী ভয়ংকর। চোখেই তাকাতে পারছিলাম না। একটি চিকন সরু রাস্তা, যার দূরত্ব হবে ৩০০ মিটার এর মতো। রাস্তার এপাশেও কিছু নেই ওপাশেও নেই। নিচে তাকালেই ২৫০০ ফুট নিচ সাথে আছে বাতাস। পুরোপুরি পিছু হটে গেলাম। এদিকে শরীর কাঁপছে, নিজের শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখা কঠিন হচ্ছিল। গাইড বলে উঠল, ভয়ংকর ও বিপজ্জনক রাস্তা তাই না যাওয়াই ভালো। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একটু সময় নিলাম। লক্ষ্যে অবিচল থাকলাম। মন বলল, পিছু হটতে নয়, জয় করতে এসেছি। রওনা হয়ে গেলাম। দুপুর ১.৪০ মিনিটে ১ জনকে বাদে বাকিরা যোগীর সর্বোচ্চ চূড়ায় অবরোহণ করি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই।
এবার ফেরার পালা। সকলে একসাথে পাড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। এদিকে সকলের কাছে পুঞ্জীভূত পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় কষ্ট হচ্ছিল। দ্রুত হেটে পাহাড় শেষ করে ঝিরিপথে আসি। এখানে হালকা বিশ্রাম নিয়ে আরো ৪০ মিনিটের মত হেটে পানি পাই। আহা! জীবন ফিরে পেলাম। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছিল। দ্রুতই ফিরতে হবে। এ বিষয়ে মনিরা ইয়াসমিন সেতু বলেন, পাহাড়ে যে অল্প কয়দিন ট্র্যাকিং করেছি তাতে একটা জিনিস শিখেছি আর তা হচ্ছে সময়ের দাম দেওয়া। এছাড়াও পাহাড়ে সূর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সকালে শুরু করতে পারলে যেমন প্রখোর রোদ থেকে বাঁচা যায় তেমনি সূর্য ডোবার আগে যদি ফিরে আসা যায় তাহলে পরের দিনের ট্রেইলে যাবার জন্য মানসিক ও শারীরিক ভাবে প্রস্তুত হওয়া যায়। পাহাড়ে সূর্য ডুবে যাওয়া মানেই চেনা ট্রেইল অচেনা হয়ে যাওয়া, কঠিন ট্রেইল নরক হয়ে যাওয়া”। পাড়ায় ফিরে এসে দেখি সবাই অপেক্ষায় আছে। যোগীহাফং বিজয়ী বলে বীরোচিত সংবর্ধনা পেলাম। ফ্রেড্ররিখ হেগেল-এর “জীবনের কোন মূল্য তখনই থাকে যখন এর মূল্য হিসাবে মূল্যবান কিছু থাকে” বাণীতে জীবনের মর্মার্থ খুঁজে পেলাম।