সুন্দরবন ভ্রমণ
শুঁটকি, রাসমেলা ও বিচিত্র জীবনধারার দুবলার চরে একদিন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, বিপুল বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন ক্রমেই সৌন্দর্য পিপাসু ভ্রমণকারীদের জন্য হয়ে উঠেছে তীর্থস্থান। আপনি কেন বাদ থাকবেন সুন্দরবন ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থেকে। ঘুরে আসুন সুন্দরবন, চারপাশে বানরের খেলা, কুমিরের চলাচল এবং হরিণের মায়াবি চোখ, কাঠের ট্রেইলে বনে হাঁটা আপনাকে দিবে এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, যার স্মৃতি বয়ে বেড়ানো যায় সারাজীবন।
দুবলার চরে যা দেখবেন
কটকা, হিরণ পয়েন্ট দেখার পর আপনার পরবর্তী গন্তব্য হতে পারে অতি সুন্দর দুবলার চর। চর হিসেবে পরিচিত হলেও স্থানটি মূলত কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে অবস্থিত একটি দ্বীপ। দুবলার চর কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এই চরকে এক কথায় বিশুদ্ধ শুঁটকির রাজ্য বলা যেতে পারে, তবে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলার জন্যও বিখ্যাত স্থানটি। ফলে সুন্দরবনে ঘুরতে এলে এই স্থানটিতে পা না মাড়িয়ে কেউ ফিরতে চান না, এবং কি শুধু এই দুবলার চরের উদ্দেশেও দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে অনেক পর্যটক।
এই চরের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। এই চরে মানুষের আনাগোনা থাকে বছরে মাত্র পাঁচ মাস, যার বেশিরভাগটাই শুঁটকিকে কেন্দ্র করে। সরকার কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রায় ২০ হাজার জেলে শুষ্ক মৌসুমে এখানে মাছ ধরার জন্য আসে এবং অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে মাছ ধরা, শুঁটকি করাসহ আনুসঙ্গিক কাজে নিয়োজিত থাকে। এই সময়টাতে শুঁটকিকে উপলক্ষ করে প্রচুর পর্যটক এখানে ঘুরতে আসে, তাদের কাছে খুচরা শুঁটকি বিক্রির জন্য রয়েছে একটি বাজারও। চরের জেলেদের সংগঠন রয়েছে, যারা এই বাজারসহ যাবতীয় বিষয় ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্ব পালন করে থাকে। এখানকার শুঁটকি বিশুদ্ধ এবং গুনগতমানে সেরা। শুঁটকি এখান থেকে চট্টগ্রাম, পরে চট্টগ্রাম থেকে দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় প্রেরণ করা হয়ে থাকে। জেলেরা এখানে মাছ ধরা এবং অস্থায়ী বসবাসের জন্য সরকারকে নির্ধারিত হারে রাজস্ব প্রদান করে থাকে। এখানে আরো একটি কারণে লোকসমাগম হয়ে থাকে, তা হলো হিন্দুদের পুণ্যস্নান এবং রাসমেলা। প্রতিবছর নভেম্বর মাসে এই ধর্মীয় উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। উৎসবে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন স্থান হতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রচুর মানুষ এখানে সমবেত হয়, ফলে এখানে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই রাসমেলার সময়ও প্রচুর পর্যটক এখানে ভিড় করে, পর্যটন এজেন্সিগুলো তখন এই রুটে চালু করে বিশেষ প্যাকেজ।
নৌযান থেকে দুবলার ঘাটে নেমে বালুতে পা ফেলে একটু এগোন, এবার আবার একটু পেছন ফিরে তাকান। মনে হবে বিস্তৃত একটি সমুদ্র সৈকত, ঘাটে জড়ো হয়ে আছে অসংখ্য নানা বৈশিষ্ট্যের নৌকা, ট্রলার, দূরে চলাচলরত পর্যটকবাহী জাহাজ, পানির হালকা স্রোতে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলছে কোন মাছ ধরার ট্রলার, জেলেরা জাল টানছে, গান গাইছে, দূরে ডানা ঝাপটে হঠাৎ করে দলবেঁধে উড়াল দিচ্ছে একঝাক সামুদ্রিক পাখি। এই অপরূপ দৃশ্য আপনাকে দিয়ে যাবে অজস্র ভালো লাগার অনুভব, যে অনুভবের জন্যই মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে। বিশাল চর এলাকা, এক কোনায় দাঁড়িয়ে কিছু অনুমান করা কঠিন, তবে এক নজরে দেখে নিতে পারেন চারপাশটা। ঘাটে নামলেই পাবেন একটি ছোট্ট দোকান, দোকানে চা পান, বিস্কটিসহ ছোটখাটো বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়। গাইড বা গার্ডের সাথে কথা বলে সুবিধামত যেকোন দিক দিয়েই হাঁটা শুরু করতে পারেন।
দোকানের পেছনের দিকে তাকলেই দেখতে পাবেন এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো ছোট ছোট অসংখ্য ছনের ঘর, যেগুলোর বড় আঙ্গিনায় শুকাতে দেওয়া আছে হরেক রকমের মাছ। আশেপাশেই অনেক লোককে দেখতে পাবেন কেউ হয়তো ঝুড়ি বোঝাই করে শুঁটকি মাথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ শুঁটকি বাছাই করছে, কেউ কেউ বসে বসে মাছ ধরার জাল ঠিক করছে। তবে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, তা হলো এখানে কোন মহিলা মানুষ দেখতে পাবেন না আপনি, অস্থায়ী বসতি হওয়ায় হয়তো মহিলাদের আসা হয় না এখানে। শুঁটকি পল্লীর ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে শুঁটকির কড়া গন্ধ আপনার নাকে এসে ধাক্কা দিবে। গন্ধ সয়ে হাঁটতে থাকুন এবং দেখতে থাকুন। হাঁটতে হাঁটতে শুঁটকির বাজারে চলে আসবেন, এখানেও দেখতে পাবেন হরেক রকমের শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানদাররা। আগেই বলেছি এখানকার শুঁটকি সেরা, দামেও তুলনামূলক সস্তা, বাড়ির জন্য ঘুরে ঘুরে আপনিও কিনে ফেলতে পারেন পছন্দমতো। চরের আরো ভেতরদিকে গেলে জেলেদের বসতি দেখতে পাবেন, জঙ্গল দেখত পাবেন। এখানে দেখতে পাবেন ছনের তৈরি চমৎকার একটি মসজিদ। ঘুরে ঘুরে দেখতে পাবেন এখানকার মানুষের কী ভিন্ন, কী বিচিত্র এক জীবনধারা। মানুষদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করে জেনে নিতে পারেন অনেক কিছু, ঝালিয়ে নিতে পারেন অভিজ্ঞতা। সর্বোপরি এই চরের সৌন্দর্য, এখানকার বিচিত্র জীবনধারার দর্শন স্বার্থক করবে আপনার ভ্রমণকে।
শুরুতেই জানা প্রয়োজন
সুন্দরবন ভ্রমণ দেশের অন্য স্থানগুলোয় ভ্রমণের চেয়ে একটু আলাদা। কারণ বনাঞ্চল হওয়ায় মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নিয়মকানুন, যেমন বন বিভাগের অনুমতি নেওয়া, গার্ড নেওয়া ইত্যাদি। ফলে নিজের ব্যবস্থাপনায় গেলে ভ্রমণের আনন্দের চেয়ে বিড়ম্বনাই বেশি হতে পারে। ঝামেলামুক্ত, সহজভাবে এবং স্বল্প খরচে সুন্দরবন ভ্রমণে ট্র্যাভেল এজেন্সির সহায়তা নেওয়াই ভালো। ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো প্রতি শুক্র, শনি এবং রবিবার খুলনা থেকে একা কিংবা দলগত, একদিনের কিংবা তিনদিনের প্যাকেজ অফার করে থাকে। আপনি সেখানে গিয়ে কিংবা আগেই যোগাযোগ করে বুকিং দিতে পারেন। আপনার সুন্দরভাবে এবং নিরাপদে ঘুরে আসার সব দ্বায়িত্ব তারাই নেবে। একদিনের প্যাকেজ সাধারণ ভ্রমণ করার সুন্দর নৌযানের মাধ্যমে 'মংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া- মংলা' ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। তিনদিনের ভ্রমণে ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের ছোটবড় সুন্দর জাহাজ। থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা জাহাজেই থাকে। তিনদিনের প্যাকেজে রোড দুটি, একটি হচ্ছে 'মংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া-কটকা-হিরণপয়েন্ট-দুবলার চর-মংলা', অপরটি 'মংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া-কচিখালি-ডিমের চর-মংলা'। একদিনের প্যাকেজ জনপ্রতি ১৫০০-২০০০ টাকা, তিনদিনের প্যাকেজ জনপ্রতি ৮০০০-১০০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এই খরচটা নির্দিষ্ট, কাররণ প্রচুর টাকা নিয়ে গেলেও বাড়তি খরচের উপায় নেই।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার বিভিন্ন বাস স্টেশন থেকে সরাসরি মংলা যায় পর্যটন সার্ভিসের অনেক বাস, নামতে পারেন খুলনায়ও, পরে খুলনা থেকে মংলা। বাস ভাড়া ৪০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকার মধ্যেই। পৌঁছানোর পর আপনার প্যাকেজ অনুযায়ী যাবতীয় ব্যবস্থা ট্যুর এজেন্সিই করবে।
কোথায় থাকবেন
জাহাজে তিনদিনের ভ্রমণে গেলে থাকা খাওয়ার সব সুব্যবস্থা জাহাজেই থাকে। একদিনের ভ্রমণে গেলে, সারাদিন বেরিয়ে এসে রাতে থাকতে পারেন বন্দর শহর মংলায়। এখানে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০৪৬৬২-৭৫১০০)।
সতর্কতা :
নৌকায় ভ্রমণের আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া আছে কি না। বনরক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না, দলছুট হবেন না। ফুড পয়জনিং থেকে বাঁচতে নিরাপদ পানি পান করুন।