বৈশাখে ঘোরাঘুরি
ছাতিয়ানীর চড়ক মেলায়
রাস্তার দুই ধারে বসেছে বৈশাখী মেলা। মাটির খেলনা, লেইস ফিতা, আসবাবপত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, কাঠের সামগ্রী, হস্তশিল্প, কারুপণ্য, তামা, কাঁসা, লোহা—কী নেই মেলায়। আরো কিছুদূর যেতেই দেখতে পাবেন একটি পুকুরকে ঘিরে আছে কয়েক হাজার মানুষ। পুকুর থেকে তুলে এনে পাড়ে রাখা হয়েছে চড়ক গাছ। এই চড়ক গাছকে সবাই পূজা দিচ্ছেন। পুকুরের মাটি দিয়ে বাঁধানো পাড়। পুকুরপাড়ের বটগাছ দেখে এর প্রাচীনতা বোঝা যায়। চারপাশে ধূপকাঠির গন্ধে মোহিত হচ্ছে, বেজে চলছে ঢাক। বন্ধুরা এই দৃশ্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে ঢাকার অদূরে অবস্থিত কালীগঞ্জের জাঙ্গালীয়া ইউনিয়নের ছাতিয়ানী গ্রামে। আড়াইশ বছর ধরে হয়ে আসছে এই চড়ক মেলা।
এই চড়ক পূজা ও মেলার প্রচলন হয় তৎকালীন স্থানীয় ধনাঢ্য হিন্দু পরিবারে। যাদের বেশির ভাগ পরিবার ’৪৭-এর দেশ ভাগ এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন। বর্তমানে এই মেলা ও পূজা পরিচালনা করেন স্থানীয় গুপ্ত পরিবারের কমল কুমার গুপ্ত। এই মেলা পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্রসংক্রান্তির দিন।
চড়ক পূজা স্থানীয়দের কাছে চড়ক দেশের পুকুরের পূজা নামেই পরিচিত। প্রতি চৈত্রসংক্রান্তির পূজার পর পুকুরে চড়ক গাছ ভিজিয়ে রাখা হয় বলে এই নাম। পুকুরে ভিজিয়ে রাখা এই চড়ক গাছ আড়াইশ বছর ধরে পূজা করে আসছে স্থানীয় লোকজন। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও লোক আসেন পূজা দেখতে।
চৈত্রসংক্রান্তির সাত দিন আগে সন্ন্যাসীরা উপবাস থেকে সারা দিন গ্রাম থেকে চাল সংগ্রহ করেন। রাতে শিবপূজা শেষ করে উপবাস ভাঙেন। তাদের এই চাল সংগ্রহ করাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ডেউল উঠানো। সাত দিন উপবাস থেকে গ্রাম থেকে চাল সংগ্রহ করে চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন হয় হরগৌরি (স্থানীয়দের ভাষায় আজরা) পূজা। তাদের বিশ্বাস, এই পূজা করার পর সন্ন্যাসীদের ওপর ভূত ভর করে। তখন ভূতেরা গ্রামের ও ভক্তদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে থাকে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন সকালে ঢাক-কাঁসা বাজাতে বাজাতে পূজারিরা চড়ক দেশের পুকুর (যে পুকুরের পানিতে চড়ক গাছ ভিজিয়ে রাখা হয়) পাড় দিয়ে আড়াইটি পাক দিয়ে চড়ক গাছ পুকুর থেকে তুলে পুকুরপাড়ে স্থাপন করেন। সেখানে প্রথমে সন্ন্যাসীরা পূজা করেন, তার পর অন্যরা পূজা দিয়ে থাকেন।
স্থানীয় লোকজন তাদের বাচ্চাদের মঙ্গল কামনায় মানত করে আর সেই মানত অনুযায়ী বাচ্চাদের চুল পুকুরপাড়ের বটতলায় উৎসর্গ করে; আবার কেউ কেউ পুকুরের জলে বিভিন্ন ফল ভাসায়। সেই ফল যেকোনো মানত করে খেলে মানুষের মনোবাসনা পূর্ণ হয় বলে তারা বিশ্বাস করে। চড়ক পূজা শেষ করে সন্ন্যাসীরা চলে আসেন শিবমন্দিরে পূজা করতে। এই মন্দিরটির সামনে রয়েছে আরেকটি বটগাছ। এই বটগাছের নিচে নিজেদের মনের কাম-ক্রোধ-পশুত্ব বিসর্জনের জন্য পশু উৎসর্গ করা হয়।
চড়ক মেলায় বিভিন্ন এলাকা থেকে মিষ্টির দোকানিরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে। নিমকি, মুরালি, মোয়া, তিলা, খাজা, কদমা, খাস্তা, পিয়াজু, শখের মিঠাই, মোয়া, বাতাসা আরো কত কী। পাবেন অত্র অঞ্চলের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান উত্তম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাঁচাগোল্লা মিষ্টি, ক্ষীরসাই। তা ছাড়া লোকনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গুড় দিয়ে তৈরি জিলাপি। নগরে গুড়ের জিলাপির দেখা পাওয়া দুষ্কর।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বিভিন্নভাবে যেতে পারবেন। ছাতিয়ানীর চড়ক পূজায় যাওয়ার প্রথম পথ হলো গুলিস্তান থেকে নরসিংদীগামী বাসে উঠে নামতে হবে নরসিংদীর পাঁচদোনায়, সেখান থেকে কালীগঞ্জগামী বাসে উঠতে হবে, নামতে হবে কাপাসিয়া মোড়ে। সেখান থেকে সিএনজি করে চলে যান ছাতিয়ানী। মহাখালী থেকে যেতে চাইলে আপনাকে উঠতে হবে চলনবিল/বাদশা বাসে। আপনাকে নামতে হবে কাপাসিয়া মোড়ে। কাপাসিয়া মোড় থেকে সিএনজি করে চলে যান ছাতিয়ানীর চড়ক পূজায়। খরচ পড়বে ১৩০ থেকে ১৮০ টাকা অথবা গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। খরচ পড়বে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা।