চলুন যাই ঐতিহ্যবাহী রায়েরকাঠি রাজবাড়িতে
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/01/11/photo-1547184917.jpg)
শতক আসে শতক যায়, কিন্তু রাজবাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে স্যাঁতসেঁতে শেওলা মেখে, কাল থেকে কালান্তরে গন্ধ ছড়িয়ে। রাজবাড়ির ঝরাপাতা, পুরোনো ধুলো, রহস্যমাখা হাওয়া মাড়িয়ে ছুটে চলে জীবনধারা। মহাকাল ছিন্ন করে বের হওয়া মানুষটা খুঁজে বেড়ায় অতীত ঐতিহ্যের। আর আপনি যদি চান অতীত ঐতিহ্যকে বহন করে এমন কোনো রাজবাড়ি দেখতে, তাহলে আপনাকে যেতে হবে পিরোজপুর জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে পৌর এলাকার রায়েরকাঠিতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়ি ও মঠবাড়িতে। আর খরচের কথা ভাবছেন, তা হাতের নাগালেই।
৩৫৭ বছরের পুরোনো কালীমন্দির এবং ৭৫ ফুট উচ্চতার ১১টি মঠ, ২০০ একর বিস্তৃত রাজবাড়ি, পিরোজপুর জেলায় অন্যতম পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা।
পিরোজপুর জেলায় পুলিশ লাইনসের কিছুটা সামনে গিয়ে ডানপাশে ১৬৬৮ সালে নির্মিত কালীমন্দির ও ১১টি মঠ। আর প্রায় কয়েকশ গজ সামনে রাস্তার বাঁ পাশে নয়ানাভিরাম ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর ধ্বংসপ্রাপ্ত কয়েকটি ভবন।
বয়সে যতই পুরাতন বা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত যাই হোক, রাজবাড়ির ভবনগুলো দেখে আপনার নয়ন জুড়াবে। এই অনুপম পুরাকীর্তি দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। ক্ষণকাল এখানে দাঁড়ালে অবচেতনেই মানসপটে ভেসে উঠবে এ রাজবাড়ির একসময়ের শৌর্য-বীর্যের রূপ।
ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজা রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এই রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রাজবাড়িতে গেলে প্রথমে দেখা মিলবে রাজবাড়ির প্রধান ফটক, তার একটু সামনে এগোলে হাতের বাঁয়ে দেখা যায় রাজাদের বসবাসের বহুতল ভবনগুলোর ভগ্নাংশ, তার সামনে রয়েছে বিচারালয়, কাছারিঘর, জলসাঘর, অন্ধকূপ তাও ভেঙে গেছে।
মুঘল আমলে নির্মিত মন্দিরের নকশা ও কারুকাজ নয়ন জুড়ানো। মন্দিরের মঠগুলোর দেয়ালে মাটির অলংকরণ ক্ষয়ে গেছে। মঠের গায়ে শেওলা ও লতাপাতা জন্মেছে। একটি মঠে (মন্দির) সংরক্ষিত আছে কষ্টিপাথরের মহামূল্যবান শিবমূর্তি। জনশ্রুতি রয়েছে, সাড়ে পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের শিব লিঙ্গটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ শিবমূর্তি। জনশ্রুতি আছে, রুদ্র নারায়ণ রায়ের আমলে এই রাজবাড়িতে মহিষ বলি দিয়ে ঘটা করে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হতো। তবে কালের বিবর্তনে রাজবাড়ি জৌলুস হারিয়েছে। এখন প্রতিবছর পাঁঠা বলি দিয়ে কালীপূজা উদযাপিত হয়।
ইট-সুড়কি দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে রাজবাড়ির প্রাসাদ ও মঠগুলো। কালের বিবর্তনে প্রায় ধ্বংসের পথে মূল রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। এখনো যে কটি ভবনের দেখা মেলে, তাও পুরোপুরি ধ্বংসের পথে। তবে কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ মঠ। সেগুলোর কয়েকটির অবস্থাও করুণ।
রাজবাড়ির ইতিহাস
পিরোজপুর জেলার ইতিহাস ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে যুবরাজ সেলিম (পরে সম্রাট শাজাহান) তাঁর বাবা সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলায় চলে আসেন।
এরপর তিনি তৎকালীন ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগনা সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগনার নাম রাখেন সেলিমাবাদ। এরপর ১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান তৎকালীন হুগলি জেলার দিগঙ্গার জমিদার রাঢ় দেশীয় সেন বংশোদ্ভব কিংকর ভূঁইয়ার ছেলে মদনমোহন। ১৬২৮ সালে মদনমোহন ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগনার কিছু জমি নেন।
শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাছারি স্থাপন করে সেখানে বসবাস করতেন। এরপর মুঘল সম্রাট শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন। ১৬৫৮ সালে রাজা শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে এসে বসবাস শুরু করেন।
একপর্যায়ে তিনি ওই বসতি এলাকার জঙ্গল কেটে ও পরিষ্কার করে রাজবাড়ি এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন-জঙ্গল কেটে ও সাফসুতরো করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বলেই এ রাজত্বের নামকরণ করা হয় রায়েরকাঠি। একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী এ রাজাদের শক্তি কমে যায় রাজপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে জমিদারি প্রথা চালুর ফলে। সে সময় রাজা রুদ্র নারায়ণ রায়ের উত্তরসূরিরা পরিণত হন জমিদারে। এর পর থেকেই মূলত রায়েরকাঠি পরিচিতি পায় জমিদারবাড়ি হিসেবে। অমরেন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন এ রাজবংশের শেষ জমিদার।
কীভাবে যাবেন
রায়েরকাঠি পৌরশহরে অবস্থিত হওয়ায় ঢাকা বা দেশের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে পিরোজপুর শহরে আসতে হবে। পিরোজপুর শহর থেকেই রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে করে জমিদারবাড়িতে যাওয়া যায়। রিকশা ভাড়া ৪০ টাকা, অটোরিকশায় জনপ্রতি ১৫-২০ টাকার মতো।
ঢাকা বা অন্যান্য জেলার সঙ্গে পিরোজপুরের বাস যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন পরিবহনের এসি ও নন-এসি বাস। ঢাকার গুলিস্তান থেকে দোলা, ইমাদ ও টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস এবং সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ে বলেশ্বর, হামিম, ফাল্গুনী। এ ছাড়া গাবতলী থেকে গ্রামীণ পরিবহন, সাকুরা, হানিফ, গোল্ডেন লাইন পরিবহন।
নদীপথে সদরঘাট থেকে লঞ্চে করেও আসা যাবে পিরোজপুরের হুলারহাট ঘাটে। সদরঘাট থেকে পিরোজপুরের হুলারহাট বন্দরগামী লঞ্চের মধ্যে অন্যতম রাজদূত, অগ্রদূত, আঁচল, টিপু, ফারহান, হিমালয়। হুলারহাট ঘাট থেকে অটোরিকশা করে পিরোজপুর শহর হয়ে রায়েকাঠি। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২০ টাকার মতো।
কোথায় থাকবেন ও খাবেন
পিরোজপুর থাকার জন্য রয়েছে সার্কিট হাউস, ডাকবাংলো ও রেস্টহাউস। এ ছাড়া রয়েছে বেসরকারি হোটেল রিল্যাক্স, রজনী, ডালাস, বলাকা, অবকাশসহ বিভিন্ন আবাসিক হোটেল। খাবারের জন্য শহরে রয়েছে আপ্যায়ন, প্রিন্স, রোজ গার্ডেনসহ মাঝারি মানের হোটেল।