ঘোরাঘুরি
মারায়ণ তং চূড়ায় স্বপ্নভোর
পাহাড়ের নেশা এক অদম্য নেশা। যে নেশার হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। তবে কর্মজীবনের শত ব্যস্ততার মাঝে ক্ষুদ্র অবসরে এই ডাকে সাড়া দিতে হলে চাই ইচ্ছেশক্তি আর যথাযথ পরিকল্পনা।
কয়েকদিন থেকেই মাথায় ঘুরছিল এই মাসে এখনো পাহাড়ের সবুজ দেখা হয়নি। যেহেতু হাতে মোটেও লম্বা সময় নেই তাই যাওয়ার আশা প্রায় বাদ দিয়েছিলাম। এর মধ্যেই আমাদের ফেসবুক ট্র্যাভেল গ্রুপ ‘জিডিএম’-এ আলীকদমের মারায়ণ তং পাহাড়ের চূড়ায় ক্যাম্পিংয়ের প্রস্তাব রাখল বন্ধু শরিফ। লম্বা সময়ের দরকার নেই। একটা দিন কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারলেই হলো। তড়িৎ সিদ্ধান্তে সবাই সম্মত হয়ে পরের রাতেই রওনা হলাম আলীকদমের পথে। এতো অল্প সময়ে বাসের টিকেটের একটা ঝক্কি থাকলেও লালন ভাইয়ের সৌজন্যে সে সমস্যারও সমাধান হয়ে গেল। রওনা হয়ে গেলাম গাড়ি নিয়েই।
চটগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ের চকরিয়া থেকে বামদিকে লামা উপজেলা পার হয়ে আলীকদমের রাস্তা। রওয়ানা দিতে দেরি করা এবং রাস্তার প্রচন্ড জ্যামের কারণে পৌছাতেই বাজলো প্রায় ১১টা। আমাদের উদ্দেশ্য যেহেতু রাতটা পাহাড়ের চূড়ায় কাটানো তাই খুব বেশি তাড়াহুড়াও ছিল না।
ফ্রেশ হয়ে নাস্তার সাথে একবারে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এর মধ্যে আগেই যোগাযোগ করে রাখা গাইড আমাদের সাথে যোগ দিল। গাইডকে সাথে নিয়েই কাঁচাবাজার জ্বালানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হলে রওনা হলাম আবাসিকের দিকে। এখান থেকেই আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে। মারায়ণ তং যেতে হলে আলীকদম না গিয়ে আবাসিক নামক জায়গাতেও বাস থেকে নেমে যাওয়া যায়। তবে ক্যাম্পিংয়ের টুকটাক কেনাকাটার জন্য প্রথমে আলীকদমে যাওয়াটাই ভালো।
আলীকদম থেকে আবাসিক গাড়িতে ১৫ মিনিটের রাস্তা মাত্র। গাড়ি থেকে নেমে পোশাক পালটে ট্রেকিং উপযোগী ট্রাউজার-জুতা পরে নিলাম। পানিসহ অন্যান্য কিছু জিনিস সবার কাছে ভাগ করে দেওয়া হলো। একটা বিষয় বলাবাহুল্য যেহেতু মারায়ণ তং যাত্রা পথে কোনো পানির উৎস নেই তাই পানি নিচে থেকেই বহন করে নিয়ে যেতে হবে। ব্যাগ কাঁধে নিয়েই টের পেলাম ব্যাপারটা খুব বেশি সুখকর হবে না। মাথার উপর দুপুরের গনগনে সূর্য আর পিঠে বিশাল ব্যাগ নিয়ে আমাদের বহর রওনা হলো মারায়ণ তং চূড়ার দিকে।
স্থানীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এই পাহাড়টিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে। কেউ বলে ‘মারায়ণ তং’, কেউ ‘মারায়ণ ডং’ আবার কেউবা বলে ‘মারাইং তং’। পাহাড়ের ঢাল থেকে সোজা রাস্তা উঠে গেছে এঁকেবেঁকে। এর মধ্যে বেশ কিছুদূর ইট বিছানো হয়ে গেছে যা হয়তো পাঁকা হয়ে যাবে শিগগিরই। একদিন হয়তো পুরো চূড়া পর্যন্তই পাকা হয়ে যাবে। সেদিন যাত্রা সহজ হলেও পাহাড়ে ভ্রমণের এই রোমাঞ্চ হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীদের সামগ্রিক সুবিধা বিবেচনায় এটাই হয়তো যথার্থ।
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমাদের ট্রেকিং শুরু হলো। কিছুক্ষণ ট্রেকিংয়ের পরই আমাদের ঝানু সব ট্রেকাররা পর্যন্ত হাঁপিয়ে উঠল। আসলে মাথার উপরের তপ্ত রোদই যেন সব শক্তি শুষে নিচ্ছিল। প্রথম দিকে ঢালুটা সহনীয় হলেও ধীরে ধীরে তা বেশ খাড়া হতে লাগল। এর মধ্যে পার হয়ে এলাম দুটো পাহাড়িপাড়া। সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে। চোখে রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে শিশুরা তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। কেউ কেউ চেষ্টা করছিল একটু দুষ্টুমি করে মনোযোগ আকর্ষণ করতে।
পাড়া পার হয়ে একটা গাছের নিচে সবাই এসে বসলাম। উপর থেকে দেখা যাচ্ছিল অবারিত সবুজ চিড়ে বয়ে যাওয়া সর্পিল মাতামুহুরী নদী। প্রায় দুই ঘণ্টার ট্রেকিংয়ের পর পৌঁছালাম মারায়ণ তংয়ের চূড়ায়। চূড়ার এক প্রান্ত দখল করে আছে সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধমূর্তির একটু আগে বিশাল বটগাছের পাশেই রয়েছে আরেকটি ছোট ভিক্ষু মূর্তি।
সন্ধ্যা হতে খুব বেশি দেরি নেই। অন্ধকার নামার আগেই রান্নার সব সরঞ্জাম আর তাঁবুগুলো প্রস্তুত করে ফেলতে হবে। দেরি না করে সবাই মিলে হাত লাগালাম। অল্প সময়েই শেষ হলো সেসব প্রস্তুতি। হাতের কাজ শেষে ফটোসেশনও হলো বেশ। সবাই আয়োজন করেই সূর্যাস্ত দেখলাম। ক্যাম্প ফায়ারে আগুন জালিয়ে সবাই মিলে গান হচ্ছিল। পাশাপাশি চলছিল রান্নার আয়োজন। রান্না শেষে কলার পাতায় খাওয়া সেই অমৃত খিচুড়ি আর ঝাল মুরগির মাংসের স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে।
সবাই মিলে জোছনা দেখা শেষে কখন যেন টুপ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোর হতেই সূর্যোদয় দেখার আহ্বানে ট্যুরমেটদের কারো ডাকেই ঘুম ভাঙল। মাঝে হাল্কা নাস্তা সেরে নিলাম। অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নের মতো এক সকাল যেন। বেশ কিছু গ্রুপ ফটোসেশন শেষে তাবু গুটানো হলো। রোদের তেজ বাড়ার আগেই এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। সকালের নরম রোদে মারায়ণ তং চূড়াকে বিদায় জানিয়ে নেমে এলাম একরাশ সুখস্মৃতি নিয়ে।
মারায়ণ তং ক্যাম্পিং করতে হলে-
ঢাকা থেকে প্রথমে আলীকদম আসতে হবে। হানিফ অথবা শ্যামলী বাস সার্ভিসে ভাড়া ৮০০ টাকা। এ ছাড়া কক্সবাজারের বাসে উঠে চকোরিয়া নেমে জিপে করেও আলীকদম আসা যায়। এখানে এসে অথবা আসার আগে গাইড ঠিক করে রাখলে সে-ই ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় লিস্ট দিয়ে দেবে এবং রান্নার সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র সংগ্রহ করে রাখবে। টুকটাক বাজার আলীকদম থেকেই করা যাবে। তবে তাবু নিয়ে আসতে হবে নিজেদেরই। সাথে আরো নিয়ে আসতে হবে ট্রেকিং স্যান্ডেল, শুকনো খাবার, টর্চ, টিসু ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র। গাইডের জন্য নির্ধারিত অঙ্ক না থাকলেও হাজার খানেক টাকা বরাদ্দ রাখতে পারেন। গাইড না এনে নিজেরাও করা যেতে পারে সব আয়োজন। তবে তা একটু কষ্টসাধ্য হয়ে যেতে পারে।