ঈদের ছুটিতে
মিউজিয়াম অব রাজাস
ছিলেন জমিদারনন্দন। অথচ নিজের গানে লিখেছেন, ‘আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়...।’ বাউলদের স্বভাবসুলভ বিনয়বশত নিজেকে কিছু নয় বলে দাবি করলেও বাংলা গানের অনেক কিছু হয়েই থেকে গেলেন হাছন রাজা। ভোগবিলাসের জীবন ছেড়ে বৈরাগ্য গ্রহণ করেন তিনি। সঙ্গীতের আশ্রয়ে পরমাত্মার সন্ধান করেন। মরমি কবির ঘটনাবহুল জীবন ও দর্শন সম্পর্কে কৌতূহলের শেষ নেই। আজও মানুষ তার স্মৃতি খুঁজে ফেরে। সে দিকটি বিবেচনায় রেখে এ মরমি সাধকের স্মৃতি রক্ষার্থে তার পরিবারের উদ্যোগে সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিউজিয়াম অব রাজাস। আসছে ঈদের ছুটির দিনগুলোতে চাইলে আপনি ঘুরে আসতে পারেন মিউজিয়াম অব রাজাস থেকে।
যা দেখবেন
প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুটি সিংহ স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বসে আছে আপনাকে অভিবাদন জানানোর জন্য। দেখে মনে হবে বহুকাল আগের পাথর মূর্তি। না জমিদার বাড়ির আবহ তৈরি করতেই এমন সংযোজন। ভেতরে প্রবেশ করলে দুটো কামরা দর্শন মিলে। বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজানো শোকেসে। একটি গ্লাস শোকেসে হাছন রাজার গানের পাণ্ডুলিপি। নিজের হাতে লেখা। বাঁশের কঞ্চি কেটে তৈরি কলম আর কালিতে লেখা গীতিকবিতা হাছন রাজার সৃজনশীলতার অনিন্দ্য প্রকাশ।
হাছন রাজার অধ্যাত্মবাদের যে পরিচয় মেলে, তাও মূলত সঙ্গীতে। একাধিক গ্লাসশোকেস সাজানো হয়েছে লোকবাদ্যযন্ত্র দিয়ে। একতারা, দোতরা, ঢোল আদি রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখানে।দ্বিতীয় কক্ষের একটি দেয়ালঘেঁষে রাখা হয়েছে হাছন রাজার নিজের রচনা ও তাকে নিয়ে লেখা বই। গ্রন্থসম্ভার। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বই ও পাণ্ডুলিপি হাছন রাজা বিষয়ক গবেষণার ফল। রাজা পরিবারে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শন থেকেও হাছন রাজাকে খুঁজে নেওয়া যায়। উদাহরণ হতে পারে প্রথম কক্ষের মাঝখানে রাখা লোহার সিন্দুকটি। হাছন রাজার পরিবারে ব্যবহৃত ৩০০ কেজি ওজনের সিন্দুক তাদের অঢেল ধনসম্পদের, মনে করা যেতে পারে, প্রতীকী উপস্থাপনা। ওই সময় বিশেষ এক ধরনের পাদুকা ব্যবহার করা হতো, যার নাম খড়ম। একাধিক আলোকচিত্রে হাছন রাজাকে খড়ম পায়ে দেখা গেছে।
জাদুঘরের এককোণে রাখা হয়েছে অন্যরূপ দেখতে খড়ম। হাছন রাজার পোশাক সম্পর্কে ধারণা দেয় একাধিক আলোকচিত্র। হাছন রাজার আলোচনায় কিছু পশু-পাখির নাম সব সময়ই এসেছে। হাছন রাজার ঘোড়াগুলোর ছিল আলাদা আলাদা নাম। যেমন কদমবাজ, লাল বড় ঘুড়ি, জিন ঘুড়ি, চান্দা, খুস দিল, বাক্কা বাহাদুর, শিং বাহাদুর, জয় বাহাদুর, সোনা লাল, বিজলি ঘুড়ি, মালতী। কত কত নাম। মোট ৭৮টি নামের উল্লেখ পাওয়া যায় জাদুঘরে। পাশের একটি ওয়াল শোকেসে রাখা আছে হাছন রাজার ব্যবহার করা ঘোড়ার লাগাম। চামড়ার বেল্টের মতো দেখতে সামান্য বস্তু এখন অমূল্য স্মারক। জাদুঘরে উপস্থাপন করা হয়েছে বেশ কিছু হাতির নাম। নামগুলোর মধ্যে রয়েছে জিবা, জঙ্গ বাহাদুর, বাংলা বাহাদুর, মাসুকজান, মুকনা, রাজরানী, সুরত জান, মঙ্গল প্যারী ও হাছন প্যারী।
হাছন রাজার কোড়ার কথা তো বার বার এসেছে গানে। এই পাখি খুব যত্ন করে পালতেন হাছন রাজা। খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজার ডায়েরি থেকে কোড়াদের বিভিন্ন নাম সংগ্রহ করেছে জাদুঘর। শখেরবশে পশু শিকারও করতেন রাজা পরিবারের সদস্যরা। তখনকার সময় এটি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। শিকার করা পশুর সিং-চামড়া জমিদারদের শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হয়ে দেয়ালে শোভা পেত। জাদঘরে রাখা হরিণের শিং যেন সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হাছন রাজা পরিবারের ঐতিহ্য আভিজাত্যের স্মারক হয়ে আছে তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন বাসনকোষন, পোশাক পরিচ্ছদে। বেগম মেহেরজান বানুর পোশাকের ছিন্ন অংশ রাখা আছে জাদুঘরে। হাছন রাজা ও তার বংশধরদের ইতিহাস জানতে জাদুঘরটি বেশ সহায়ক।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে ভাড়া ৩৬০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। সেখান থেকে জিন্দাবাজারে অবস্থিত মিউজিয়াম অব রাজাস যেতে ভাড়া নেবে ৪০ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।