ইস্তাম্বুলের অন্দরে
ইস্তাম্বুলের আড্ডা
আড্ডা এক প্রকার সফর। কত দূর আগামীতে চলে যাওয়া যায়। আবার চাইলে ঘুরে আসা যায় পেছনে। সুতরাং সফল বললে আমার প্রথম গন্তব্য আড্ডা। দেশে এবং দেশের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর কত নিমন্ত্রণ টেবিল ওপর জমে থাকে। উল্টে-পাল্টে দেখি সফরের কাফেলার সঙ্গীদের সাথে তর্কে কত গভীরে নামা যাবে কিংবা ভাবনার ফানুস উড়ানো যাবে কতটা। কাফেলা পছন্দ না হলে পা বাড়াই না। সে যত লোভনীয় সফরই হোক। তাই বলে সফরে নামিনা তা নয়। দেশের ভেতর ঘুরে বেড়ানোতে ক্লান্তি নেই। প্রতি ঋতুতে নদী, পাহাড়, সাগর কিংবা শুধু ফসলের মাঠ, কোনো এক তমাল বা বড়ই গাছ দেখতেই বেড়িয়ে পড়ি। জল শূন্য নদীর টানও কম নয়। মানুষের জন্যও মনপুড়ে। চলনবিলে কোনো গভীর রাতে বাইলা মাছের ঝোল খেতে বসেছিলাম যে ঝুপড়িতে, সেখানে পাশের বেঞ্চিতেই বসে বিড়ি টানছিলেন এক মধ্যবয়সী। তাঁর অবয়বের ভাঁজগুলো আত্রাইয়ের ঢেউয়ের ভাঁজের মতো মনে হয়েছিল। তাকে দেখার ব্যাকুলতা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম সেই পথে। নাগেশ্বরীর পথের পাশের চায়ের দোকানের সেই কিশোরী? ফিরে আসার সময় জানতে চেয়েছিল, আবার কি ফেরা হবে? তার টানে কতবার ধরলা পাড়ি দিলাম।
মন আর নাড়ীর টান বুঝি শিরায় শিরায় বইতে থাকে তিতাস আর কৃষ্ণ সাগরের মতোই। তাই তো উড়াল দেওয়া ইস্তাম্বুলে। কয়েকদফা বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম নিমন্ত্রণ। যাওয়া-আসা, মাঝে একদিনের জন্য আট দুগুণে ষোল ঘণ্টার যাত্রার ধকল নেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল না। অম্বলের যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। কিন্তু কাফেলার অন্য যাত্রীরা চেপে ধরল, ইস্তাম্বুল নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। আকাশে আড্ডা হবে তুমুল, অতএব চলুন। এই চাপাচাপির আড়ালে শিরায় একটি টানও অনুভব করছিলাম। মন পুড়ে যাচ্ছিল আজগর আলীর জন্য। তিনি আমার পূর্ব পুরুষ প্রপিতামহ। ব্রিটিশ সরকারের চাকরি নিয়ে ইস্তাম্বুল গিয়েছিলেন। তখন তুরস্কের রাজধানী ছিল ইস্তাম্বুল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নিভৃত গ্রাম খাগাতুয়ার এই তরুণ পরবর্তী সময়ে তুরস্ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গ্রামে আসা-যাওয়া এক পর্যায়ে থেমে যায়। বিয়ে করেছিলেন যাকে তিনি তুর্কী। তাদের সন্তানরা বাবার ভিটে দেখার আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু আমাদের মহাসাগর সমান কৌতূহল তাদের দেখবার। বারংবার খোঁজ করা হয়েছে পরিবার থেকে। তুরস্ক গিয়ে পূর্ব-পুরুষদের কেউ কেউ আজগর আলীর খোঁজ করেছিলেন। তত দিনে তিনি বেঁচে না থাকায়, তাঁর সন্তানদের দেখা পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। তারপরও টান এখনো টানটান। তাই অবশেষে দিলাম উড়াল। উড়োজাহাজে আকাশকন্যা এসে কফির পেয়ালা যখন হাতে ধরিয়ে দিল, আমি সেই তুর্কি কন্যার চোখে চোখ রাখি। নিমজ্জিত হতে চাই তার চোখে, এই আকাশ কন্যাও তো হতে পারে আমার স্বজন। তার কাছে আজগর আলীর গল্প বলি। আমার জানা নেই তাঁর বসবাস বসফরাসের কোন পাড়ে ছিল। ইউরোপ নাকি এশিয়ায়? আকাশ কন্যা আমাকে তুরস্কের স্বজনই ভাবল। প্রায় আট ঘণ্টার উড়ালে কফি আর ফলের রসে এক প্রকার জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিল।
ইস্তাম্বুলের যে বন্দরে উড়োজাহাজ নামল, এটি নতুন। মাস পাঁচেক আগে উদ্বোধন করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান বন্দর বলে দাবি করা হচ্ছে। আগের কামাল আতার্তুক বিমানবন্দর মূল শহরের অন্দরে। নতুনটি কৃষ্ণ সাগরের তীরে। পাহাড়, বন কেটে তৈরি হয়েছে। বিমান বন্দরের আশপাশে এখনো জনপদ গড়ে উঠেনি। মূল শহর থেকে সর্বোচ্চ দেড়শ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালিয়ে গেলেও সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। হোটেলের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই আপন মনে হতে লাগল শহরটি। কারণ খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের মতো পাহাড়ের শরীরে গড়ে উঠা শহর। বসতিগুলোও একই রকম ঘনিষ্ঠ ভাবে তৈরি। বাড়ি ঘরের নান্দনিকতা চোখ টানল। চোখ কেড়ে নিল পথের দুই পাশের দেয়াল ও সড়ক দ্বীপে ফুটে থাকা ফুল। যেন কোনো তুর্কি কন্যার নিজ হাতে বোনা কার্পেট। আমাদের হোটেলটিও বেশ উচুঁ পাহাড়ের ওপর। রাজপ্রাসাদের মতো প্রকাণ্ড হোটেল। তার আঙিনাও ফুলের কার্পেটে মুড়িয়ে দেওয়া। হোটেল কক্ষে গিয়ে ভড়কে গেলাম। এত রাত্রিবাসের জন্য নয়, হৈ হুল্লুর করার বিশাল ময়দান।
কাফেলার সহযাত্রীরা উড়োজাহাজে বসে দুশ্চিন্তায় চা, কফি পান করতে পেরেছিলেন কি না সন্দেহ। তাদের দুশ্চিন্তা কেনাকাটা নিয়ে। উড়োজাহাজ থেকে নেমেই বিমানবন্দর থেকেই তারা কেনাকাটা শুরু করতে চেয়েছিলেন। আমি তাদের দমিয়ে রেখেছি। আগে শহর চেখে দেখি। হোটেলে বোচকা রেখেই সবাই নেমে এলেন, সময় কম এখন কেনাকাটা শুরু না করলে, আর সময় পাওয়া যাবে না। আমি কিছু না বলে তাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। হোটেলের নিচে উপরে বিপণিবিতান। এ দিকটায় পর্যটক বলতে আমরাই। সবাই তুর্কি। আমাদের বড় বিপণিবিতানগুলোর মতোই কেনাকাটার ছুঁতোতে মূলত আড্ডা দিতে বা খেতে এসেছে। চারদিকে বেঞ্চিপাতা। মুখোমুখি দুই বেঞ্চিতে দুই জোড়া বোন পেয়ে গেলাম। প্রথম দুই বোনের কারো বয়সই ত্রিশ পেরোয়নি। শেষ বিকেলের রোদ তাদের আরো সুন্দর করে তুলেছিল। আমার সহযাত্রীরা দুই বোনের আড্ডার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তাদের সঙ্গে নিজস্বী তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কী করবেন বেচারার বিপণিবিতানগুলোর জৌলুস দেখে, একটিতেও ঢোকার সাহস পাননি। অবশেষে এই দুই তুর্কী তরুণীর জৌলুসে পুড়বার সাধ হয়েছে তাদের। উল্টো দিকে দুই হুইল চেয়ারে বসা দুই বোন। তাদের একজনের আটাত্তর, অন্যজন বিরাশি। দুজনার দুই ছেলে হুইল চেয়ারের পেছনে দাঁড়ানো। তারা দুজনই অধ্যাপক। আমি তাদের মায়েদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা নাজিম হিকমতের অনুরাগী। আমিও তাই। বড়বোন বললেন – চলে যাচ্ছি। যেমন পৃথিবী চেয়েছিলাম। তেমন পৃথিবী গড়া হলো না। নাজিম হিকমতের সুর। তিনি আমার দিকে সদ্য ফোটা লাল টিউলিপ বাড়িয়ে দিলেন। আমি প্রেমে পড়লাম তাঁর ঠোট দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানের রক্তিম রসের ।