দেখে আসুন রাবির শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা
সবুজের সমরোহ আপনাকে আপন করতে চায়, কিন্তু আপনারই ফুসরত মিলছে না। হঠাৎ করে একদিন মনে হলো, আর পেরে উঠছি না! এবার একটু কোথাও ঘুরে আসা যাক। হাতে যে তালিকাটা আছে, তার প্রায় সবটুকুই দেখা শেষ। তাই আপনার মন চাইছে নগরীর বাইরে যেতে। তো, আর দেরি কেন? ঘুরে আসুন ঢাকার বাইরে সবুজের সমরোহে সবুজ গাছপালার ঘন রঙে আচ্ছাদিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে চোখ-জুড়ানো সবুজের সমারোহে সৌন্দর্যের প্রতীক প্যারিস রোড, সাবাশ বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা দেশের সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে এই সংগ্রহশালা ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি চমৎকার স্থাপত্যনৈপুণ্যে সমৃদ্ধ মোট ছয় হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের তিনটি গ্যালারি নিয়ে গড়ে উঠেছে। খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সংগ্রহশালাটি যাত্রা শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে এটি সংগ্রহের দিক থেকে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। এতে স্থান পেয়েছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন চিত্রকর্ম, দলিল-দস্তাবেজ, আলোকচিত্র, জামা, জুব্বা, কোট, ঘড়ি, পোশাক, টুপি, কলমসহ বিভিন্ন দুর্লভ জিনিস।
প্রথম গ্যালারিতেই দেখা হয়ে গেল ঘুরতে আসা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী উজ্জ্বল হোসেন সায়েমের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘বহু প্রাণ আর ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের এ বাংলা ভাষা। প্রথম গ্যালারিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনারের বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র, আমতলার সভা, কালো পতাকা উত্তোলন ও মিছিল এগুলো দেখে আমি যেন অজান্তেই স্মৃতির পাতায় ফিরে যাচ্ছি, যা দেশপ্রেম আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বুদ্ধিজীবী শহীদ ড. জোহার ছবি আবারও স্মরণ করিয়ে দিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কীরূপ সম্পর্ক হওয়া উচিত। সত্যিই আদর্শের প্রতীক ড. জোহা।’
দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১০৮টি আলোকচিত্র, ৩৫টি প্রতিকৃতি, নয়টি শিল্পকর্ম। এ ছাড়া রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত নানা জিনিস। এখানে সংরক্ষিত আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, রাবির শহীদ শিক্ষকদের প্রতিকৃতি, ’৭১-এর গণবিক্ষোভ ও বীভৎস গণহত্যার দুর্লভ ছবি প্রভৃতি। আরেক দর্শনার্থী আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জুয়েল রানা বললেন, ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হচ্ছি। এমন দেশে জন্মগ্রহণ করে সত্যিই গর্ব হচ্ছে। শহীদদের এ আত্মত্যাগ সত্যিই দেশকে ভালোবাসতে ও দেশের জন্য কিছু করতে আমাদের অনুপ্রাণিত করছে। তাই গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সব শহীদকে।’
তৃতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১১২টি আলোকচিত্র, ৪০টি ডায়েরি- পাণ্ডুলিপি, পোশাক ও ৫৬টি ঐতিহাসিক জিনিসপত্র। এখানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, রণাঙ্গনে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, বিজয়ী মুক্তিসেনা, হানাদারমুক্ত ঢাকা শহর, গণকবর, বুদ্ধিজীবী হত্যা, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র (মাইন, বুলেট, রকেট লাঞ্চার ইত্যাদি), শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদ সাংবাদিকদের ছবিসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি আলাদা বোর্ড, রাবির গণকবর থেকে প্রাপ্ত নাম না জানা অসংখ্য শহীদের মাথার খুলি-হাড়-দাঁত-শার্ট কাপড় ও তাঁদের ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিস। এ ছাড়া রয়েছে শিল্পী কামরুল হাসানের মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার এবং শিল্পী আমিনুল ইসলামের শ্বেতপত্র-৭১, চলচ্চিত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধ।
এই সংগ্রহশালাটির স্থায়ী গ্যালারি দর্শকের জন্য ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৯ ফাল্গুন ১৩৯৬ সাল) উন্মুক্ত করে দেন তিন শহীদ শিক্ষক পত্নী ওয়াহিদা রহমান, মাস্তুরা খানম ও চম্পা সমাদ্দার।
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দেশের প্রথম শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি দর্শন করতে প্রতিদিন শতাধিক দর্শনার্থী আসেন। আমেরিকা, জাপান, ভারত, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশের দর্শনার্থী এখানে ঘুরে গেছেন।
কীভাবে যাবেন?
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে চোখ-জুড়ানো সবুজের সমারোহ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, বধ্যভূমি প্রভৃতি। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা দেখতে চাইলে আপনি বাস ও ট্রেনে দুভাবেই আসতে পারেন। ঢাকার গাবতলী থেকে রাজশাহী আসতে ভাড়া নেবে বাসভেদে ৪০০-৫০০ টাকা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান গেটে নেমে সামনে তাকালেই দেখা যাবে প্রশাসনিক ভবন, প্রশাসন ভবন থেকে ডান দিকে দুই মিনিট হাঁটলেই দেখতে পাওয়া যাবে শহীদ মিনার। এর পাশেই অবস্থিত শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। এ ছাড়া ঘুরে আসতে পারেন রাজশাহীর অন্যান্য দর্শনীয় স্থান বাঘা মসজিদ, পুঠিয়া রাজবাড়ী, পদ্মার চর, চিড়িয়াখানা, জিয়া পার্ক, সারদা পু্লিশ একাডেমি প্রভৃতি। সব কাছাকাছি বলে একসঙ্গে ঘুরে দেখা সম্ভব।