ঘরভোলানিয়া ‘তাসমানিয়া’
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার দ্বীপদেশ পূর্ব তিমুর থেকে এক রৌদ্র ঝলমল সকালে শুরু হয়েছিল আমাদের মাসব্যাপী অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ। অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ন টেরিটোরির উষ্ণ মণ্ডলীয় ডারউইন থেকে বিমানযোগে একেবারে মহাদেশটির এ মাথা থেকে ও মাথা উড়ে শীতপ্রধান অ্যান্টার্কটিক আবহাওয়ার তাসমানিয়াতে। তারপর সিডনি, ব্রিসবেন, গোল্ডকোস্ট প্রভৃতি জায়গায় যাওয়া হয়েছিল। কোনো কাজে নয়, একেবারে নিছক গ্লোব ট্রটারের মতো।
সুদীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে থাকতে থাকতে পূর্ব তিমুরের গড় ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার সঙ্গে এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, পৃথিবী নামক গ্রহটির কোথাও যে শীতের প্রাধান্য থাকতে পারে, তা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। একেবারে অভ্যস্ত ছিলাম হালকা সুতির আরামদায়ক নরম পোশাক-আশাকে। তাই কিছু না ভেবেই অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের প্রাক্কালে সুতির হালকা কাপড় চোপর স্যুটকেসে ভরেছিলাম। ডারউইন অবস্থানগতভাবে পূর্ব তিমুরের কাছাকাছি দেড় ঘণ্টার বিমানযাত্রার দূরত্বে হওয়ায়, সেখানে যেয়ে তাপমাত্রার এবং পরিবেশগত বিশেষ তারতম্য অনুভব করিনি, তিমুরের তুলনায় বেশি সাজানো গোছানো বাড়িঘর, রাস্তাঘাট এবং এবরিজিনদের দলবল উপস্থিতি ছাড়া। তিমুরে আমি চার বছর অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কাজ করতাম বলে অস্ট্রেলিয়ান মানুষজন আমার চোখে নতুন ঠেকেনি সেই ভ্রমণকালে।
কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া কাকে বলে, তা টের পেয়েছি হাড়-মজ্জা কাঁপানো তাসমানিয়ার শীতে কেবলমাত্র একটি পাতলা পশমিনা শাল সম্বল হিসেবে নিয়ে গিয়ে। কথায় বলে না, ‘বাবু মরে শীতে আর ভাতে’? আমার হয়েছিল কাঁটায় কাঁটায় সে দশা। সাথে শীত নিবারণের পর্যাপ্ত বস্ত্র নেই, নেই বাঙালসুলভ রসনাবিলাসের ভাত-মাছ-ডালের আয়োজন সে পরবাসে। কেএফসি, পিজ্জা অথবা শুধু নুন-গোলমরিচ মাখা খাবারে বাঙালির ক’বেলা পোষায় রে ভাই!
তাসমানিয়ার হুবার্ট এয়ারপোর্টটি আয়তনে তেমন বড় না হলেও সাজানো গোছানো ছিমছাম। পেছনে ছোটখাটো একটি পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে রাডারের ঘূর্ণন মন্দ লাগল না নেমে। সেখান থেকে ভাড়া গাড়িতে আগে থেকে অনলাইন বুকিং দিয়ে রাখা মোটেলে। কয়েকদিন ডারউইন ভ্রমণ এবং তাসমানিয়ার উদ্দেশে লম্বা বিমান উড়াল। একটু ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। তাই মোটেলে পৌঁছেই গোটা পরিবার, মানে আমি, অদিতা, হাসিব তিনজনেই প্রথমেই খুঁজে নিয়েছিলাম রুম হিটারের উষ্ণতায় দুগ্ধফেনিভ শয্যাবিলাস। কনকনে ঠান্ডা শীতের দেশে বিছানা ততোধিক ঠান্ডা হবে, মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম। তাই যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম কয়েক স্তর কম্বলের নিচে ঢাকা শয্যার আরামদায়ক উষ্ণতা অনুভব করে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে যে বিছানা গরম রাখার জন্য চাদরের নিচে অ্যাডজাস্টেবল তাপমাত্রার ইলেকট্রিক ব্ল্যাংকেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তা আসলে জানাই ছিল না আমার। বাইরে হাড় কাঁপানো শীতার্ত রাত্রিকে উপেক্ষা করে ঘুম ঘুম প্রশান্তিতে সে রাত মগ্ন হয়েছিল দূর আকাশের তারাদের সাথে মৌনমগ্ন নিভৃত আলাপনে।
লেইট রাইজার হিসেবে আমার বাসার তিনজনই কে কাকে হারিয়ে প্রথম স্থান দখল করবে, তা রীতিমতো প্রতিযোগিতার বিষয়। ছুটির দিনে কেউই বিছানা ছাড়তে চাই না সহজে। তাই ছুটির এই অবকাশে পরদিন তিনজনই বেলা করে ওঠার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। অবশ্য সুযোগ পেলে কখনোই হাতছাড়া করি না আমরা সূর্যি মামা মধ্য গগনে উঠে গেলে ভোর দেখার অভ্যাস। মোটেলের কর্মচারীরা কখন যে সামনের জানালার বাইরে থেকে ওপেন করা যায় এ রকম কাউন্টারে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে গেছে জানতেই পারিনি। নিশ্চয়ই ঘুমকাতুরে আরো লোকজন আসে এখানে, তাই এ বন্দোবস্ত। টিপিক্যাল ইংলিশ ব্রেকফাস্ট সেখানে, পাউরুটি -ডিম-মাখন-জ্যাম-জেলি-চা-কফি-ফলমূল। হ্যাম-বেকন মনে হয় আমরা মুসলিম হওয়ায় সার্ভ করেনি বুদ্ধি করে। প্রচুর ফল সেখানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় বলে আপেল-কমলা-স্ট্রবেরির জ্যাম চমৎকার উপাদেয়।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সকালের নাশতায় বিপুল জনপ্রিয় ‘ভেজিমাইট’ কালচে রঙে এবং উৎকট স্বাদে আমার কাছে অখাদ্য ঠেকল। নানা হেলথ বেনিফিট আছে নাকি এই ভেজিমাইট নামক জ্যামের। তাই অস্ট্রেলিয়ানরা সকালের নাশতায় পাউরুটিতে মেখে খেতে পছন্দ করে। আমার তো, ভেজির পরে মাইট নাম দেখেই কেমন যেন পাতাকপি অথবা বেগুন কাটলে হঠাৎ হঠাৎ যে শ্বেত অথবা সবুজাভ নরম শরীরের মথ-জাতীয় পোকা বের হয়, ওগুলোর কথাই মাথায় এলো। মনে বদ্ধমূল ধারণা হলো, অনেক মথ-জাতীয় পোকা ফার্মে চাষ করে, একসাথে ব্লেন্ড করে চিনি দিয়ে সেদ্ধ করে তারপর বানানো হয়েছে এই কুদর্শন জ্যাম। কৌতূহলবশত একবার টেস্ট করেই, আর ইহজনমে মুখে নেব না এ জিনিস, তা যতই খাদ্যগুণে ভরপুর হোক, বলে কঠিন প্রতিজ্ঞা করলাম। সে সংকল্প এখন পর্যন্ত স্থির অটল আছে, ভবিষ্যতেও টুটার সম্ভাবনা কম। তবে সে বস্তুটি আসলেই পোকা দিয়ে বানানো হয় কি না, সে রহস্য উন্মোচনের চেষ্টাও চালাইনি আর। হয়তো দেখা যাবে আপনমনে উদ্ভট এক ধারণা করে বসে আছি নিজে নিজেই। তবু থাক না কিছু উদ্ভট ভাবনা মাথায়। সব যুক্তিপূর্ণ হিসাবি ভাবনা হলে, যাপিত জীবন কেমন জানি ভারী ঠেকে আমার কাছে।
আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ সমুদ্রতীরবর্তী ব-দ্বীপ হওয়া সত্ত্বেও দেশের কোনো সি-বিচে কখনো সিগালের দেখা মিলেছে আমার বলে মনে পড়ে না। নাকি কক্সবাজার থেকে স্পিডবোট অথবা নৌকায় মহেশখালী যাওয়ার সময় দেখেছি কয়েকটি? মনে নেই ঠিক। শুধু গল্প-কবিতায়-গানে উপমা উৎপ্রেক্ষার আদলে স্বপ্নিল এক অনুভব দোলা দিয়ে গেছে মনে, সি-গালের শুভ্র ডানায় পড়ন্ত রৌদ্রবেলার মায়াবী আলোর সম্মোহন স্পর্শ মনে এলে।
তাই পরদিন সকালে স্নান ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়ে হুবার্ট শহর দেখতে বেরিয়ে, বহুশত বছরের ঐতিহ্যবাহী সালামানকা মার্কেটে যাওয়ার পথে, সমুদ্র ঘেঁষা মেইন রোডের তীরে ছোট-বড় অনেক নৌকা আর জাহাজের পাশাপাশি, হাজার হাজার সি-গালের মেলা দেখে নিমেষেই বুঝে গেলাম, পৌঁছে গেছি আমি এক ভীষণ অচেনা তুষার কন্যার দাপুটে রাজ্যপাটে।