কাশ্মীর
ঝিলম নদীর মূলে
‘সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা,/আঁধারে মলিন হল— যেন খাপে ঢাকা/বাঁকা তলোয়ার’ (বলাকা)। রবিঠাকুর এই কবিতাটি লিখেছিলেন কাশ্মীর ভ্যালির শ্রীনগরে বসে। বাংলা ভাষায় ঝিলম নদীর এটাই শ্রেষ্ঠ বর্ণনা বলে আমার ধারণা। কাশ্মীরের মানুষের শিল্প-সাহিত্য, গান-কবিতা, রূপকথায় ওই ‘জেহলাম’ (কাশ্মীরি উচ্চারণ) এক গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান। উপত্যকার মানুষ ও প্রকৃতির সেসব কথা যেন জীবন্ত করে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাটিতে। তিনি লিখেছিলেন,
‘অন্ধকার গিরিতটতলে/দেওদার তরু সারে সারে;/মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে/বলিতে না পারে স্পষ্ট করি,/অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
যেসব বাঙালির কাশ্মীরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে, তাঁরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছেন কবিতার এই বর্ণনা ও সচক্ষে দেখা সবুজ বাস্তবতা। পর্বতের পাদদেশে সারি সারি দেওদার গাছ, শহরের পেট কেটে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা নদীর কলকল ধ্বনি, শীতের তুষারে ঢাকা তুল-কাতুর (জমাট বরফ) আর গ্রীষ্মের স্নিগ্ধ সবুজ—এই তো কাশ্মীর! গত অক্টোবরে (২০১৪) মুক্তি পাওয়া বলিউডের চলচ্চিত্র ‘হায়দার’-এর আবহ সংগীতের ‘জেহলাম, জেহলাম’ শব্দও নিশ্চয়ই অনেকের কানে বাজতে শুরু করেছে। সেই জেহলাম নদীর মূল উৎসস্থল থেকে আজ পাঠককে নিয়ে একটু ঘুরে আসা যাক।
শ্রীনগর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে মধ্য হিমালয়ের পর্বতমালার নাম পীর পাঞ্জাল। ওই পর্বতমালা পেরিয়েই জম্মু থেকে প্রবেশ করতে হয় কাশ্মীর ভ্যালিতে। ওখান থেকে কাশ্মীর অঞ্চলের প্রথম জেলার নাম অনন্তনাগ (ইসলামাবাদ)। মূলত পীর পাঞ্জাল পর্বতরাশির গা থেকে চুইয়ে পড়া পানিই একীভূত হয়ে বয়ে গেছে নদী হয়ে, যার নাম ‘জেহলাম’। অনন্তনাগ জেলার রাস্তার পাশে, হাটে-মাঠে যেখানেই যাবেন, দেখা মিলবে পাহাড়ি পানির ঢল ঝর্ণা হয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে মধ্যরাতের নীরবতা কিংবা স্নিগ্ধ ভোরের পাখিদের ডাকও মিলিয়ে যায় ঝর্ণার কলকল শব্দের ভেতর। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সে কথাই লিখেছেন, ‘শব্দময়ী অপ্সর-রমণী/গেল চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি।/উঠিল শিহরি/গিরিশ্রেণী তিমির-মগন/শিহরিল দেওদার-বন।’
ওখানকার অসংখ্য ছোট-বড় ঝর্ণার প্রবাহ ঝিলম নদীর সঙ্গে মিশেছে। তবে নদীটির মূল উৎসস্থলের নাম ‘ভেরি নাগ’। শ্রীনগর থেকে ওই ঝর্ণা ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতা ছয় হাজার ১৫৪ ফুট (এক হাজার ৮৭৬ মিটার)। মূল উৎসস্থলটি পর্বতের পাদদেশে একটি গভীর কূপের মতো। মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলে ওই উৎসস্থলটিকে একটি অষ্টকোনাকার কংক্রিটের কাঠামো দিয়ে আবদ্ধ করার কাজ শুরু হয়। কাজটি শেষ হয় শাহজাহানের আমলে। তার মধ্যে স্থাপন করা হয় কয়েকটি গোসলখানাসহ রাজকীয় ব্যবস্থা। ভেতরের দৃশ্য দেখতে হলে পায়ের পাতা ভিজিয়ে ঢুকতে হবে দর্শনার্থীকে। অবশ্য তীব্র ঠান্ডা পানিতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি পা ডুবিয়ে রাখা এক কঠিন ব্যাপার। সেখান থেকে নিরন্তর আসতে থাকা পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রাখা হয়েছে নির্দিষ্ট একটি কংক্রিটের ক্যানেল। পুরো এলাকায় লাগানো হয়েছে নানা ফুলের গাছ ও ছায়াদার চিনার বৃক্ষ।
ওখান থেকে দুটি বড় পর্বত পেরিয়ে আরেকটি ঝর্ণার নাম কোকরনাগ। সেটিও ঝিলমের অন্যতম উৎসমূল। এর আসল নথিভুক্ত নাম হলো বিন্দুজলাঙ্গম। কিন্তু লোকমুখে কোকরনাগ হিসেবেই পরিচিতি এর। এ নিয়ে প্রচলিত আছে নানা রকম গল্প ও রূপকথা। অনেক ছোট ছোট ঝর্ণা একসঙ্গে মিলে একটি মোরগের বোলের মতো হয়েছে সেখানে। কাশ্মীরি ভাষায় মোরগকে বলা হয় ‘ককের’। তাই ওই ঝর্ণার নাম হয়েছে ‘ককেরনাগ’। রূপকথা এখানেই শেষ নয়। কথিত আছে, সাধু গোস্বামী কোনো একসময়ে সেখানে গিয়েছিলেন একটি বালতি নিয়ে। তিনি সেখানে নিচ্ছিলেন বিশ্রাম। এমন সময় পাহাড়ি জঙ্গল থেকে রূপসী নারীদের একটি দল নামে পানির খোঁজে। কোথাও পানি না পেয়ে তারা ঘুমিয়ে থাকা সাধুর বালতিতে পানি আছে ভেবে তা থেকে তৃষ্ণা মেটানোর কোশেশ করে। বালতির মুখ খুলতেই বেরিয়ে আসে এক নাগ (সাপ)। সাপটি মাটিতে নেমে হামাগুড়ি দিতে থাকে। ক্রমান্বয়ে সেটা বদলে গিয়ে একটি মোরগের রূপ নেয়।
তার পর খুঁড়তে থাকে মাটি। আর মাটি থেকে বেরিয়ে আসে পানির ঝর্ণাধারা। তাই এর নাম ককেরনাগ। ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এটি কাশ্মীরের বৃহত্তম স্বাদু পানির ঝর্ণা। জওহরলাল নেহরুসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি সেখানকার সুস্বাদু-সুমিষ্ট পানির ভক্ত ছিলেন বলেও কথিত আছে।
এ রকম ছোট-বড় অসংখ্য ঝর্ণা মিলেই সৃষ্টি হয়েছে জেহলাম নদী। কোথাও পাহাড় কিংবা পর্বতের গা ফুঁড়ে কলকল করে বেরিয়ে এসেছে জল। কোথাও দেখা গেছে, পাহাড়ের গায়ে একটু একটু করে সিঞ্চিত হচ্ছে পানি। সুবীর নন্দী তাঁর গানে যাকে বলেছেন ‘পাহাড়ের কান্না’, এ যেন তাই। সেই ফোঁটা ফোঁটা পানি ক্রমান্বয়ে গড়ে তুলেছে ঝর্ণা। দূরসমুদ্রের ডাকে সাড়া দিতে ঝর্ণাধারা এগিয়ে গেছে নদী হয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। যেমনটা বুঝেছি মান্না দের গানের উপমায়, ‘ঝর্ণা কেমনে হয় নদী?/সাগর না ডাকে তারে যদি।’ বাংলার এসব গান-কবিতার জীবন্ত মঞ্চায়ন হয়েছে যেন জেহলাম নদীতে। বিরাট পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা বিন্দু বিন্দু জলরাশি শ্রীনগর শহর হয়ে চলে গেছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (আজাদ কাশ্মীর)। সেখানে সিন্ধু (ইন্দাস) নদের সঙ্গে এক হয়ে নেমে গেছে ভারত মহাসাগরে।