ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ
ভ্রমণপিপাসুদের সঙ্গী
গহিন বনে-জঙ্গলে, উচ্ছল কোনো ঝরনার পাশে বা কোনো এক পাহাড়ের ওপর তাঁবুতে রাত কাটানো, নিজের রান্না করা খাবার খেয়ে খোলা আকাশের নিচে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া... অদ্ভুত, তাই না?
সাত-আট বছর আগে আমাদের দেশে ব্যাকপ্যাকিং, ক্যাম্পিং, ট্রেকিংয়ের মতো অফবিট ট্র্যাভেলিং একদমই জনপ্রিয় ছিল না। সেই সময়ে মনে অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই শুধুমাত্র সঙ্গী-সাথীর অভাবে ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। জীবন সংগ্রামের ঘানি টেনে ক্লান্ত বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে সবাই চায় ছুটিটা কাটবে কোনো আরামদায়ক হোটেল বা রিসোর্টে। কেউ কি তখন রোদ মাথায় নিয়ে মাইলের পর মাইল পাহাড়ি রাস্তায় ভারী একটা বোঝা কাঁধে নিয়ে হেঁটে যেতে চাইবে? কে চায় নরম তুলতুলে বিছানার আরাম ছেড়ে শক্ত পাথরের ওপর গা এলিয়ে দিতে?
কিন্তু প্রতিটি বন্ধুর পরিমণ্ডলের মাঝে এমন কেউ তো থাকবেই, যে চায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে, নতুন কিছুর খোঁজে। নতুন জায়গা, নতুন বসতি, নতুন বন, নতুন পাহাড়, নতুন কোনো ঝরনা।
এমনই একজন ঘোরাঘুরির সমমনা সঙ্গীর অভাববোধ করে আট বছর আগে তৈরি করেছিল এই ফেসবুক গ্রুপ ‘ট্র্যাভেলার্স অব বাংলাদেশ’ (টিওবি)। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এই গ্রুপের মাধ্যমে সব সদস্য ঘোরাঘুরির জন্য সমমনা সঙ্গী খুঁজে পাবেন। একই সাথে সব সদস্য নিজেদের ভ্রমণের খুটিনাটি অন্য সবার সাথে শেয়ার করবেন, একে অন্যকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করবেন। একসাথে মিলে দুর্গম জায়গাগুলো এক্সপ্লোর করবেন। অপ্রচলিত অথচ সুন্দর জায়গাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরবেন। সর্বোপরি সবাই মিলে এমন একটি শক্তিশালী কমিউনিটি তৈরি হয়ে উঠবে, যেন ঘোরাঘুরি আর দূরপথে অ্যাডভেঞ্চারের স্পৃহা আমাদের দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।
সাত বছর পর আজকের এই দিনে অবস্থা একদমই পালটে গেছে। এখন আর ঘুরতে যাওয়ার জন্য সঙ্গীর অভাব হয় না। উল্টো কাকে রেখে কাকে বাদ দেওয়া যায় এই নিয়ে মুশকিলে পড়তে হয়। একসময় বিদেশি টিভি ও ম্যাগাজিনে দেখা তাঁবু এখন সবার মাঝে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এখন সদস্যরা কান পেতে শুনতে যায় গহিন বনের ডাক, গা ভেজাতে যায় পাহাড়ি ঝরনায়, দিগন্ত দেখতে উঠে পড়ে উঁচু পাহাড় চূড়ায়, উপভোগ করে সাগরতলের জীবন। প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে প্রকৃতি থেকেই জীবনীশক্তির রস আস্বাদন- এই হচ্ছে টিওবির মূল লক্ষ্য!
গত মাসে ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশের ৫০ হাজার সদস্য পূর্ণ হলো। সেই উপলক্ষে আয়োজন করা হয় একটি গেট টুগেদার ক্যাম্পিংয়ের। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয় মৌচাক, গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১৬০ জন সদস্য এতে অংশ নেন। পদ্ম পুকুরের পাড়ের সবুজ ঘাসের ওপর ৬৮টি তাঁবু খাটানো হয়। সাথে ছিল ১০টিরও বেশি হ্যামক। কেউ কেউ তো নিজের হাতে বানানো তাঁবু ও টার্প নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
এই ইভেন্টে টিওবির বার্ষিক প্রকাশনা ‘ভ্রমণ কথামালা’-এর দ্বিতীয় সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এই সংকলনে আছে সদস্যদের ঘোরাঘুরি আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্প। পড়তে পড়তে যে কেউ হারিয়ে যাবেন অ্যাডভেঞ্চারের দুনিয়ায়। অনুষ্ঠানে আরো দেখানো হয়, টিওবির এই পথপরিক্রমার একটি টাইমলাইন। সদস্যদের বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার কার্যক্রম নিয়ে তৈরি করা একটি মনোমুগ্ধকর তথ্যচিত্র।
রাতে পুকুর পাড়ে আয়োজন করা হয় বিশাল ক্যাম্প ফায়ার। গনগনে কয়লার আলোয় দলে দলে সদস্যরা গানবাজনা, গল্পগুজবে মাতিয়ে রাখে পুরো সময়। এরই ফাঁকে কুশলবিনিময় হয়, পুরনো কোনো মজার স্মৃতি মনে করে হয় হুল্লোড় বা ভবিষ্যতের কোনো ট্রিপ ফাঁদার দুষ্ট ফন্দি এঁটে বসে কেউ কেউ। ফ্যাকাসে চাঁদ পুকুরের ওপর দিয়ে ঢলে পড়লে শেষ হয় এক স্বপ্নিল রাত।
ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশে দীর্ঘ সাত বছরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ ৬৫ হাজারেরও বেশি সদস্যের বিশাল এক পরিবার। এই পরিবারের সদস্যরা ঘুরতে ভালোভাবে, রোমাঞ্চ ভালোবাসে। ঘোরাঘুরিবিষয়ক তথ্যের এক বিশাল ভাণ্ডার এখন টিওবি। নতুন জীবনবোধের নাম টিওবি। আপনাকে স্বাগতম এই খোলা উঠানে, ঘুরিয়েদের আড্ডা জমে যেখানে।