নদীপথে একটানে, সোজা গিয়ে সুন্দরবনে!
‘বাপরে! মেলায় কী নেই বলো! চাকা, কাঁচ, আলকাতরা, তামাক, চামড়া, পেঁয়াজ, কত রকমের দোকান…থলিতে যদি তোমার রুবল তিরিশেকও থাকে, তাহলেও গোটা মেলাটা কিন্তু কেনা যাবে না।’
—সরোচিনেৎসের মেলা/নিকোলাই গোগল
এই গল্পটি ১৮৩০ সালে লেখা। মহান রুশ সাহিত্যিক নিকোলাই গোগল যখন এটি লিখেছেন, তখন কি জানতেন রাসমেলার গল্প? আমাদের সুন্দরবনের এই ঐতিহ্যবাহী মেলার বয়সও কিন্তু এই গল্পের মতোই পুরোনো, পৌনে দুইশ বছরের। আর বিশাল এই মেলার ব্যাপ্তি এখন এমনই, সারা দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও অতিথিরা এসে দেখেন এই আয়োজন।
এত পুরোনো যে মেলা, তা নিয়ে একটু বাড়তি উচ্ছ্বাস তো হবেই। তবে সে উচ্ছ্বাস যদি মেটাতে চান স্বচক্ষে দেখে, তাহলে রাস্তা বিশেষ সোজা নয়। একেবারে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার মতোই অবস্থা। রূপসা ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস গাইডের সঙ্গে ছিল আমার যাত্রা। সদরঘাট থেকে সেই যে লঞ্চে উঠলাম, রাসমেলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে পাক্কা তিন দিন কেটে গেল পানির রাজ্যে। লক্ষ্য দুবলার চর। সুন্দরবনের লেন-বাই লেন-তস্য লেন দেখতে দেখতে বিচিত্র এই অঞ্চলে গিয়ে ভিড়ল তরী। যেখানে যেদিকে দুচোখ যায় কেবল শুঁটকি আর শুঁটকি। যাদের শুঁটকির গন্ধ একেবারেই ধাতে সয় না, তাদের নাকেও পরিবেশের হাওয়াটা বিটকেলে ঠেকবে না। সাগরপাড়ের ফিনফিনে বাতাস যে রয়েছে!
সুন্দরবনের ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা একটু ব্যতিক্রম হয়ে উঠতে পারে, যদি পদ্ধতি হয় নতুন কিছু। ঢাকা থেকে একবারে সরাসরি সুন্দরবন, মাঝে কোনো ট্রেন বদলানোর বা বাসে ওঠার বা সেখান থেকে জলযানে সওয়ার হওয়ার হ্যাপা নেই। সদরঘাট টু ডিরেক্ট সুন্দরবন। রূপসা ট্যুর অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের অফারটা ছিল এমনই। তিনতলা এক ঢাউস সাইজের এক লঞ্চ, তার মধ্যে শখানেক যাত্রী আমরা। লক্ষ্য দুবলার চরের আলোর কোলের রাসমেলা বটে, তবে আসল আনন্দ তো নদীপথে চার-পাঁচটা দিন নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনের। মনে পড়ে, এই কটা দিন আমার ঠিকানা বলতে স্রেফ ‘কেবিন নং এস২২১’টাই মাথায় ছিল। ধোঁয়া জঞ্জাল আর ব্যস্ততার ঢাকা শহরকে পুরোপুরি ছুটি দেওয়া হয়েছিল কি না এই সময়টার জন্য!
সুন্দরবনের জন্য সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠলাম। কেবিনে জিনিসপত্র রেখে আশপাশে হাঁটছি। নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা বাদে যখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে সবাই পৌঁছে গেছেন, তখন বিকট এক আওয়াজ দিয়ে ঢাকাকে বিদায় দিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল লঞ্চ। দেখছি তখন, ঢাকা শহর আস্তে আস্তে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। সামনে নতুন গন্তব্য। যাত্রা কেমন হবে, তা নিয়ে একটু সংশয় কাজ করতে থাকে মনে। তবে এই সংশয়, ভয়, আর দ্বিধা যখন ভ্রমণে আসে—তখনই নাকি উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে ওঠে। এ কথা আমার নয়, আলব্যেয়র কামু বলেছিলেন। আমিও ভাবলাম, এই যাত্রা যেমনই হোক, তা চুপচাপ উপভোগ করে যাওয়াটাই চাই।
রাতের বেলা, আমাদের গাইড মিথুন ভাই সবাইকে দোতলায় আমন্ত্রণ জানালেন। ট্যুর নিয়ে একটু ব্রিফ করাটা দরকার ছিল। অনেকের মনেই তখন রোমাঞ্চ, সুন্দরবন যাওয়া হচ্ছে, না জানি বাঘের সঙ্গেই একটা সেলফি তোলার সুযোগ পাওয়া যাবে। সে আশায় জল ঢেলে তিনি জানালেন, তার ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা দুই দশকের বেশি; তবে এই লম্বা টাইম ফ্রেমে তিনি বাঘের দেখা পেয়েছেন হাতে গোনা দু-তিনবার। কাজেই এমন আশায় বসে থাকলে নিরাশ হওয়ার সম্ভাবনাই কেবল রয়েছে।
আমাদের ট্যুরের পরিকল্পনা ছিল এমন, প্রথমে বগী নামের একটি স্থানে আমরা থামব। সেখানে ফরেস্ট অফিসের কাছ থেকে নির্ধারিত অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নিয়ে আমাদের লক্ষ্য কটকা অভয়ারণ্য পৌঁছে যাওয়া। সেখানে সকালে সি-বিচ আর অভয়ারণ্য দেখে পরদিন জামতলা, টাইগার পয়েন্ট, তারপর বাদামতলী সি-বিচ। এরপর কোকিলমণি, তিনকোণা আইল্যান্ড হয়ে হিরণ পয়েন্ট। সেখান থেকে রাসমেলার মূল পয়েন্ট দুবলার চর, যা আমাদের লক্ষ্য। মেলা দেখে আর পুণ্যস্নানের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার পরে আবার রিটার্ন টু ঢাকা। রূপসা ট্রাভেলসের সুন্দরবন ট্যুরের প্ল্যান সব সময়ই এমন। যাঁরা যেতে চান, এই প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজ থেকেই বিস্তারিত আপডেট পাবেন।
কটকার সবচেয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল ভোর-সকালে উঠে লম্বা হাঁটা দেওয়ার পথে একপাল হরিণের দেখা পাওয়া। তার পরে যখন ছোট্ট সি-বিচটায় পৌঁছলাম, দেখলাম সাগরের দাপট কাকে বলে! ভীষণ ঢেউ আর স্রোত। সেখানে সাইনবোর্ডে লেখাও আছে সতর্কীকরণের কথা। কেউ যদি যান, শুধু শুধু পানির সঙ্গে বাহাদুরি দেখাতে যাবেন না। এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, মাথায় রাখবেন। আরেকটা কথা, কোনো রকমের ময়লা বা খাবারের প্যাকেট বা পানির বোতল ফেলে বন-জঙ্গল বা পানির দূষণটা করবেন না।
জামতলায় হরিণ, বানর আর বন্য শূকরের কথা শুনলেও এখানে তেমন কিছুই দেখার হয়নি। দ্বিতীয় দিন শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম কোকিলমণি ফরেস্ট অফিস। সেখান থেকে আবারও নতুন করে অনুমতি নেওয়া।। এরপর সময়ে সময়ে তিনকোণা আইল্যান্ডও যে কখন পৌঁছে গেলাম, টেরই পেলাম না। পাব কী করে। যেদিকে দুই চোখ যায় খালি অথৈ জলরাশি আর চারপাশে বন-বনানি। সারা জীবন সুন্দরবনের যে বিচিত্র গাছপালার নাম শুনেছি, সেগুলো স্বচক্ষে দেখছি আর দেখছি। তবে ধরে দেখার সুযোগ নেই।
মাঝে বেশ কিছু জায়গায় নেমে সামান্য ট্র্যাকিংয়ের সুযোগ মিলছে বটে, তবে সতর্কতা সেখানে সর্বোচ্চ। বাঘের দেখা মিলুক আর না মিলুক, পায়ের ছাপ পাওয়া গেল টাটকাই। অর্থাৎ, বাঘ মামা আপাতত ত্রিসীমানায় না থাকলেও এ মহল্লায় তার আনাগোনা নিয়মিত! বনের মধ্যে কোনো রকম আওয়াজ করতে আমাদের নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। আর সেইসঙ্গে নির্দেশনা রয়েছে লাইন ধরে চুপচাপ চলার। কোনো অবস্থাতেই আলাদা হওয়া যাবে না। আমাদের লঞ্চে অধিকাংশ মানুষই এসেছেন পরিবার নিয়ে। কাজেই সাবধানতা ছিল জরুরি।
এদিকে ফোনের নেটওয়ার্ক তো এতটুকু নেই। চুপচাপ বই পড়া, গান শোনা আর নিস্তরঙ্গ জলরাশিকে দেখে যাওয়া; সেইসঙ্গে সময়মতো খাওয়ার সময়ে টোকেন নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করে খেয়ে ফেলা। এরই মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্ব হয়ে গেল কয়েকজন মানুষের সঙ্গে। শাওন ভাই, সামিউল, সাফাত, ফয়সাল, ইফাদ, সাদি, রুবাইয়াত, ইশরাত আপা; সবার সঙ্গে যোগাযোগটা সেখানে হলেও তৈরি হয়ে গেল সব সময়ের জন্য।
দুবলার চরে পৌঁছবার পরে মিলল নেটওয়ার্ক। সেখানে একটি নির্দিষ্ট মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো। আমরা বিকেলের দিকেই রওনা হয়ে গেলাম রাসমেলা দেখার জন্য। লঞ্চ থেকে ট্রলারে করে চরে যাওয়া। দুবলার চরে শুঁটকির রাজত্ব। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করার জন্য শুকোতে দেওয়া হয়েছে। এসব দেখছি আর হাঁটছি। সবশেষে মেলার একেবারে যাকে বলে মূল দরজা, সেখানে এসে পড়লাম। সেখানে দেখি নাগরদোলা। দেখে আর কী লাগে, চড়তেই হবে! ছেলেবেলার স্মৃতি চাঙ্গা করে তোলার সঙ্গে আরেকটা বিষয় লক্ষ করলাম, নাগরদোলাটা যাঁরা অপারেট করছেন, তাঁদের দুঃসাহসী পরিচালনা দেখে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছড়া হতে পারে অনেকেরই।
তবে সত্যি বলতে, রাসমেলাকে যদি সেই প্রাচীন ফ্লেভার আর বৈচিত্র্যে ভরা এক আয়োজন মনে করে কেউ গিয়ে থাকেন; তাদের আশা গুড়ে বালি হয়েছে। ক্রমান্বয়ী আধুনিকায়নের পাশাপাশি অনেক কিছুর প্রভাবই পড়েছে এর ওপর। কমোডিটি ফেটিশিজমের জাল আঁকড়ে ধরেছে এই প্রাচীন আয়োজনকে। আর দশটা মেলার মতোই সাধারণ আয়োজন, তবে পরিসরটা বেশ বড়।
রাতে ফেরার সময় অনেকটা দুর্ঘটনার মতোই দশা। লঞ্চ যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে স্রোতের টানে চলে গেছে বহুদূর। এদিকে ট্রলারের মাঝি তো আর সে কথা জানে না। সে বসে আছে পুরোই অন্যদিকে। বেশ খানিকটা সময় পারে অপেক্ষা করতে হয়েছে। পরে তো লঞ্চে উঠে অনেকেই রেগে অস্থির। পরিস্থিতি একটু খ্যাপাটে হয়ে উঠলেও শেষটায় সবাই শান্ত হয়েছে বটে।
এর মধ্যে দারুণ এক প্রাপ্তি ছিল নদীর বুকে লঞ্চের ছাদে সুপারমুন দেখতে পাওয়া। ঢাউস চাঁদ, ঠান্ডা ঠান্ডা রাত, শহর আর কোলাহল থেকে বহুদূরে চলে যাওয়া; আর কী লাগে। এই সব দেখতে দেখতে ঢাকায় চলে আসতে কেমন যেন এক আতঙ্ক হচ্ছিল। ফেরার দিনে বগী পৌঁছবার পরেই মোবাইলের নেটওয়ার্ক জীবন্ত হয়ে উঠল, ফেসবুকের জমে যাওয়া নোটিফিকেশন, মেসেঞ্জারের টিংটিং আওয়াজ, মেইলে জমা হওয়া একরাশ দরকারি-অদরকারি চিঠি। অনেকটা আঁতকে উঠে ফোনটাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তবে সেটাই বা কতক্ষণের জন্য, ফোন তো আবারও খুলতেই হয়, ঢাকাতেও ফিরতে হয়।
মাসখানেকের মতো সময় পেরিয়ে গেছে, তবে চোখ বুজলেই এখনো দিব্যি মনে পড়ে সুন্দরবন, নদীপথের ঝকমকে নিস্তরঙ্গ সময়, ক্ষণিকের অরণ্যের দিনরাত্রি। এই তো জীবন, তাই না!