প্রকৃতির আলোয় বনলতা
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/04/01/spiral_path.jpg)
গ্রিন লাইন পরিবহনের রাজারবাগ কাউন্টারে বসা আমরা। বাস ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগেই বাসে উঠে প্রস্তুতি যাত্রার। যাইহোক সময় মতোই বাস ছাড়ল। শেষ বিকেলের সোনালি রোদকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলছি সিলেটের দিকে। ঢাকার বিখ্যাত যানজট তেমন আজ পেল না আমাদের। শুদ্ধ’র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের আতিথিয়েতায় ঘুম শুরু করে দিল। অবশ্য শুদ্ধ যেখানেই যায় না কেন বাসে উঠলেই সে ঘুম দেবেই, সেটা ৩০ মিনিটের যাত্রা হোক আর পাঁচ ঘণ্টা হোক। যাইহোক বাস চলছে তার নিজস্ব গতিতে। আমারও চোখটা বন্ধ হবার উপক্রম। এর মাঝে বাসটা ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিল। আর বাস থেকে নেমে আমরা হালকা খেয়ে নিলাম। কিন্তু ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতি দিলেও এই যাত্রা বিরতি আধ ঘণ্টায় পৌঁছাল।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2024/04/01/cotage_labono.jpg)
যাত্রা বিরতি শেষে আবার যাত্রা শুরু। সন্ধ্যা শেষে রাতের নিস্তব্ধতা। রাত তখন সাড়ে ১০টা বাস এসে থামল সিলেটের কদমতলী বাস স্ট্যান্ডে। আগের থেকেই আমাদের থাকার স্থান নির্ধারিত ছিল। ইকো রিসোর্ট বনলতা। সিলেট শহর হতে খুব কাছে মাত্র ৪০ মিনিটের পথ বনলতা। আমরা বাস থেকে নেমেই বনলতার পথে পা বাড়ালাম। ক্লান্তি এখন দেহ জুড়ে। তাই যত তাড়াতাড়ি বনলতায় যাওয়া যায় ততই ভাল। বনলতা নামের কেমন জানি মায়া জড়িয়ে আছে। জীবনানন্দ দাশের জন্যও হয়তো। আমরা এগিয়ে চললাম বনলতার পানে। শুরুতে দারুণ এক শহীদ মিনার দেখলাম নগরীর চৌহাট্টায়। মনে হলো পাহাড়ের মধ্যে শহীদ মিনারটি দাড়িয়ে আছে। চৌহাট্টা পাড়ি দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। চলতি পথে দুই পাশে চা বাগানের দেখা পেলাম। যাওয়ার পথে একবার নয় দু-দুবার প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু আঁধার রাতে ছবি তুলতে পারলাম না আমরা। আঁকাবাকা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছালাম বনলতায়। বনলতায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতির উষ্ণ অভ্যর্থনা।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2024/04/01/cotage_oroni.jpg)
শহরের কোলাহল হতে মুক্তি পাওয়ার এ যেন এক বড় পাওয়া। আমাদের সকল ক্লান্তি মুছে গেল বনলতায় ঢুকে। ছোট্ট একটি লেকে নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। আলো আঁধারের মাঝে ঝি ঝি পোকা তার ছন্দে গেয়েই চলছে। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চললাম। সারি সারি গাছের ফাঁকে আলো আঁধারের খেলা অসাধারণ লাগছিল। একেবারেই প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বনলতা গড়ে উঠেছে। আমি আর শুদ্ধ উঠলাম বাঁশের অরণি কটেজে। বাকিরা উঠল মাটির কটেজ লাবণ্যে। একটু পরেই আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংক দেওয়া হলো। সারাদিন ক্লান্তি শেষে লেবুর শরবত আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল। সেখানকার সার্ভিস পারসন বললেন এই লেবুর শরবতের লেবু রিসোর্ট থেকেই সংগ্রহিত। একটু পরেই আমাদের রাতের খাবার দেওয়া হলো। অনেক দিন পর মাটির থালা বাসনে খাবার খেলাম। অসাধারণ স্বাদ, আমি অনেক জায়গায় ঘুরতে যাই কিন্তু বনলতার রান্নার স্বাদ একটু ভিন্ন অন্য জায়গার থেকে।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2024/04/01/cottage.jpg)
যাইহোক চটপট রাতের খাবার খেয়ে আমরা নিদ্রায় গেলাম। পাখির কিচির মিচির এর শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙল। দিনের আলোয় এবার আমাদের বনলতাকে দেখার পালা। চারটি কটেজ এর দেখা পেলাম আমরা। সবগুলো ইকো কটেজ। কোনটি বাঁশের কটেজ আবার কোনটি মাটির কটেজ। কটেজগুলোর নামের ভিন্নতা মুগ্ধ করেছে আমাদের। কোন কটেজের নাম অরণী কোনটা লাবণ্য, কোনটা সূর্যশিশির আবার কোনটা চারুলতা। পাহাড় সমভূমি সমন্বয়ের দারুন বনলতা। শুদ্ধ ঘুম থেকে উঠেই দোলনায় দুলতে লাগলো। অন্য সদস্যরা কেউ ক্যারাম খেলার ঘরে কেউ আবার লুডু খেলায় মগ্ন হয়ে পড়ল। কিছু সময় পরে আমাদের মাঝে সকালের নাস্তা দেয়া হলো ডিম ভাজা আর ভুনা খিচুড়ি, অসাধারণ স্বাদ। আমি মনে মনে ভাবছিলাম রান্নার এতো স্বাদের কারণ কি? একবার বনলতার হেঁসেলে যেতে হবে।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2024/04/01/live_brbq.jpg)
সকালের নাশতা শেষে আমরা চলে গেলাম রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টে। বনলতা হতে একেবারে হাঁটার দূরত্বে রাতারগুল। ঘড়ির কাটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময় যে কিভাবে ছুটে চলে। ঘুরাঘুরি করে অনেকটা ক্ষুধা লেগেছে সবার। আমরা রাতারগুল থেকে ঘুরে এসেই সরাসরি বনলতার হেঁসেলের দিকে পাড়ি জমালাম। রোসনা খালা নামে একজন খুব মন দিয়ে রান্না করছেন মাটির চুলায় আমাদের জন্য। বনলতার রান্নার এতো স্বাদের কারণ এবার বুঝতে পারলাম। এবার মধ্যাহ্ন ভোজনের পালা। আগের থেকেই আমরা মেন্যু বলে দিয়েছিলাম।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2024/04/01/brbq.jpg)
খাবার জন্য দারুণ একটি ব্যবস্থা দেখলাম। একসঙ্গে অনেকজন বসা যায়। আর সেখানে বসে পুরো রিসোর্ট দেখা যায়। আর তার সঙ্গে বাড়তি পাওয়া হলো প্রতিবেশি দেশ ভারতের নয়নাভিরাম পাহাড়ের সৌন্দর্যগুলো। মাটির চুলায় রান্নায় অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায়। সেই স্বাদ আমাদের মুগ্ধ করে। খুব যত্নের সঙ্গে আমাদের আপ্যায়ন করা হলো। খরচটাও খুব কম ছিল। মোটামুটিভাবে সবার জন্য সহজলভ্য। সেদিন খাওয়াটা একটু বেশিই হলো। খাওয়া দাওয়া করে আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য আবার বনলতার ছায়াবিথীতে গেলাম।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/04/01/soil_cotage.jpg)
প্রকৃতির অনন্যরূপ বারবার মুগ্ধ করছিল আমাদের। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে আমাদের বিকালের নাস্তা দেয়া হলো। খুবই ঘরোয়া পরিবেশে আমরা যেমন বাসাবাড়িতে সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা খাই তেমনটি দেয়া হলো। রাতে ছিলো বারবিকিউর আয়োজনও । ঝি ঝি পোকার ডাক আর গ্রামীন আবহ আমাদের তৃপ্ত করলো। রাতের খাবার খেয়েই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা উঠেই আমাদের রওনা দিতে হবে নগরজীবনের পথে। এবার যাওয়ার পালা। দারুন সব অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা ফিরছিলাম। বনলতা পুরোটাই প্রকৃতির সাথে নিবিড় হয়ে আছে। । যখন ফিরে আসছি, তখন পেছন থেকে সীমান্তের দিগন্ত ছোঁয়া মেঘালয় পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর বলছে, আরো কিছুক্ষণ থেকে যাও বন্ধু। বনলতার নয়নাভিরাম প্রকৃতি কাউকে নিরাশ করবে না আশাকরি।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2024/04/01/soil_cotage_labonno.jpg)
যেভাবে যাবেন
বনলতা সিলেট শহর হতে মাত্র ৪০ মিনিট দূরত্বে রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টের কাছেই রাম নগরে অবস্থিত। একেবারে মূল রাস্তার উপর বনতলার অবস্থান। আপনি সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সাহেব বাজার অভিমুখী সিএনজি নিয়মিত পাওয়া যায়। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৩০ টাকা। সাহেব বাজার পৌঁছে রামনগর বনলতা ইকো রিসোর্টে যাবো বললে যে কেউ নিয়ে যাবে।
খাবার খরচ
খাবার খরচ খুব কম বনলতার। ১৫০ টাকা হতে শুরু করে ৫০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। খাবার তালিকায় দেশি মাছ, মুরগী ও হাঁস পাবেন।
কটেজ ভাড়া
শ্রেণি ভেদে কটেজ ভাড়া ২৫০০ টাকা হতে শুরু করে ৬ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রতিটি কটেজে এটাচ ওয়াশরুম রয়েছে। রয়েছে তাবু নিবাসেরও। তাবু নিবাস মাত্র ৫০০ টাকা। প্রতিটি কটেজের ক্ষেত্রে সকালের নাশতা এবং বিকালের নাশতা ফ্রি পাওয়া যাবে।