কতটা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ তালেবান সরকার, কতটা বিরোধ
২০২০ সালের শুরুর দিক। দখলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন আফগানিস্তান ছেড়ে দেওয়ার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। কাতারের রাজধানী দোহায় দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠক হচ্ছে। প্রায় ২০ বছর ধরে সশস্ত্র তালেবানের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চালিয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে সেই সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শন্তিচুক্তি করে ফেলল।
তালেবানের পক্ষে যে কজন এই শান্তি প্রক্রিয়ার আলোচনায় অংশ নেন তাদের মধ্যে শের মুহাম্মদ আব্বাস স্ট্যানিকজাই অন্যতম। (এখন তিনি দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন।) ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি তাঁর কাছে প্রশ্ন করেছিল, তালেবান ফিরে আসছে, এমন খবরে সাধারণ আফগানরা ভীত। তাদের ব্যাপারে কী বলবেন?
আনন্দে উদ্বেলিত তালেবান নেতা স্ট্যানিকজাই উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি তাদের বলতে চাই, তালেবান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকার গঠন করবে।’ ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ শব্দটা স্ট্যানিকজাই খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন বলে বিবিসির প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন।
২০ বছরের দখলদারিত্ব শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বছরের ৩১ আগস্ট আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার পর পরই ক্ষিপ্রগতিতে একের পর এক প্রদেশ, শহর দখলে নিতে থাকে তালেবান। কয়েকদিনের মাথায়, ১৫ আগস্ট প্রায় বিনাযুদ্ধে রাজধানী কাবুল দখল করে নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। তালেবানের এই ক্ষিপ্রগতি শুধু আফগানদের নয়, সারা বিশ্বের জেনারেলদেরও অবাক করে দেয়!
তালেবানের একমাত্র রাজনৈতিক কার্যালয় রয়েছে কাতারের দোহায়। সেখানের কার্যালয়ে থেকেই তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার সংশ্লিষ্ট বৈশ্বিক পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছেন। (বারাদার এখন তালেবান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।) কাবুল দখলের পর তালেবান সরকার গঠনের আলোচনা চালাতে একটি বিশেষ বিমানে করে তিনি দোহা থেকে দেশে ফিরে আসেন।
কাবুল বিমানবন্দরে নেমে মোল্লা আবদুল গনি বারাদার তালেবান সরকারের চরিত্র সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা এমন একটি সরকার গঠন করতে চাই, যে সরকার আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে।’
তার কয়েকদিন আগেই অবশ্য কাবুলে প্রথম প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে এসে তালেবান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘আমরা শান্তির পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমরা দেশের ভিতরে আমাদের কোনো শত্রু চাই না, দেশের বাইরেও না।’
অর্থাৎ কাবুল দখলের পর থেকেই তালেবান নেতারা সব সময়ই বহুধা-বিভক্ত আফগান সমাজের জন্য একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ও ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের’ জন্য সরকার গঠনের তৎপরতা চালোনোর আশ্বাস দেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা হয়েছে- সেই প্রশ্ন উঠেছে সরকার গঠনের পর পরই।
তালেবান কি একটা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার’ গঠন করতে পেরেছে?
‘সেটা তো বহুদূর’- মনে করেন বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক লাইস ডাওসেট। তিনি মনে করেন, আফগানিস্তানে কোনো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার’ হয়নি; সেখানে ‘একচেটিয়া তালেবান-নির্ভর’ সরকার হয়েছে। আর যে সরকার গঠন করা হয়েছে তার পরতে পরতে রয়েছে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার (আমিরুল মোমেনীন) ছায়া।
লাইস ডাওসেট বলেন, ‘তালেবান সরকার গঠন করা হয়েছে পশতুন উপজাতির লোকজনকে নিয়ে। শুধুমাত্র একজন তাজিক এবং একজন হাজারা আছেন। উভয়েই আবার তালেবান নেতা। একজন নারীও নেই। এমনকি উপমন্ত্রীও না।’
বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদক ক্যাথি গ্যানন বলেছেন, ‘সরকারের বেশিরভাগ প্রভাবশালী পশতুনদের মধ্যে থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ এ ধরনের ব্যাপার নতুন সরকারের স্বীকৃতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী করে তালেবানের যে সরকার গঠন করা হয়েছে সেখানে উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আবদুল সালাম হানাফি। ক্যাথি গ্যাননের মতে, ‘আবদুল সালাম হানাফি একজন জাতিগত উজবেক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে তালেবানের নেতা। তার পক্ষে সংখ্যালঘুদের দাবি পূরণ করার সম্ভাবনা কম।’
এ ছাড়া হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজউদ্দিন হাক্কানি এখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। ভয়াবহ ও ঘৃণ্য সব হামলার জন্য কুখ্যাতি আছে হাক্কানি নেটওয়ার্কের। তিনি আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড, তার মাথার দামও ঘোষণা করা হয়েছিল। সিরাজউদ্দিনের চাচা খলিল–উর–রহমান হাক্কানি শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন, ২০১১ সালে জাতিসংঘের ঘোষিত জঙ্গি তালিকায় তার নাম আছে। একই তালিকায় আছেন সম্প্রচারমন্ত্রী নাজবুল্লাহ হাক্কানি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে উচ্চশিক্ষামন্ত্রী শেখ আবিদুল্লাহ হাক্কানির বিরুদ্ধে। মন্ত্রিপরিষদে এদের নিয়োগ বিশ্ব নেতৃত্বের সমালোচনার মুখে পড়েছে।
আফগানিস্তান বাংলাদেশের চাইতে প্রায় চারগুন বড়; কিন্তু জনসংখ্যা চারগুন কম। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় চার কোটি। অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আর জাতিগত সংখ্যালঘুর বাস এই দেশে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা ৯৯ শতাংশের বেশি। সুন্নি প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং বাকিরা শিয়া সম্প্রদায়ের। খ্রিস্টান (০.০৭), বাহাই (০.০৬), বৌদ্ধ (০.০২), হিন্দু (০.০১) শতাংশ, শিখ দু্ই হাজার ২০০, বাহাই ৪০০ জনের মতো আছে।
কোনো উপজাতীয় গোষ্ঠীই ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। তবে সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এখানে পশতুনদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তারাই আফগানিস্তানের রাজনীতির নিয়ন্তা। তারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ। এ ছাড়া তাজিক ২৫ শতাংশ, হাজারা ১৯ শতাংশ (অধিকাংশই শিয়া) ও উজবেক ছয় শতাংশ। এর বাইরে তুকর্মিন আছে।
তালেবানের জন্ম এই পশতুনদের মধ্যেই। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে। একে ‘ডুরান্ড লাইন’ বলা হয়। এর একপাশে আছে পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়া আর অন্যদিকে আফগানিস্তানের সাদরান অঞ্চল। পশতুনদের প্রভাব আফগানিস্তানের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে। শিয়া হাজারাদের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে হাজারাজাত। সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশ থাকে বামিয়ানের দিকে।
জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের আবিদ হোসেন কোরেশি এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার সঙ্গে আফগানিস্তানের সাদরান অঞ্চলের সংস্কৃতি, ভাষার মিল রয়েছে। সেখানকার পশতুভাষীরাই জন্মগতভাবে তালেবানের প্রধান শক্তি।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, আফগানিস্তানে তাজিক আর হাজারাদের সঙ্গে পশতুনদের বিরোধ দীর্ঘকাল ধরেই। তাদের মধ্যে সংঘাতের পরিমাণ এত বেশি যে তারা একে অপরকে ‘সবচেয়ে বড় শত্রু‘ মনে করে।
কেমন শত্রুতা? সেটার একটা উদাহরণ দিয়েছেন পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমেরিটাস গ্রান্ট ফার। ভদ্রলোক আফগানিস্তান ও ইরানে বেশ কিছু সময় কাজ করেছেন। তিনি ই-ইন্টারন্যাশাল রিলেসেন্স সাইটে এক নিবন্ধে লিখেছেন, হাজারা শিয়ারা তালেবানদের হাতে নির্যাতিত। তালেবান সুন্নিরা মনে করে না শিয়ারা প্রকৃত মুসলমান। তালেবান যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসে (১৯৯৬-২০০১) তখন হাজারা জনগোষ্ঠীর ওপর অন্তত তিনটি গণহত্যা চালিয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল ১৯৯৮ সালে মাজার-ই শরিফের গণহত্যা। শত শত হাজারা পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। এতে কয়েকজন ইরানি কূটনীতিককেও প্রাণ দিতে হয়। এমনকি ২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরও হাজারাদের ওপর এই আক্রমণ অব্যাহত ছিল। রাজধানী কাবুল থেকে হাজারাজাত অভিমুখি যাত্রীবাহী বাসগুলোকে থামিয়ে হাজারা পুরুষদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো এবং হত্যা করা হতো। মধ্য এশিয়ার শারীরিক বৈশিষ্টের কারণে তাদের সহজেই ধরা পড়তে হতো।
তবে গ্রান্ড ফার এটাও উল্লেখ করেছেন, কাবুল দখলের কিছু আগে তালেবান তাদের নিজেদের সংবাদ সংস্থা আল-ইমরাহ’র মাধ্যমে প্রপাগান্ডা চালাতে শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওকে ব্যবহার করে তারা প্রচার চালায়। একজন শিয়া ধর্মীয় নেতা আফগানিস্তানের শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের মার্কিন হানাদার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। এতে শিয়াদের ধারণা হয় যে, হয়তো তালেবানের প্রত্যাবর্তনে তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অনেকে লড়াইয়েও যোগ দেয়।
কিন্তু এখন তাহলে ক্ষমতার ভাগ থেকে বঞ্চিত হওয়া গোষ্ঠীগুলো কী করবে? সেই প্রশ্নও ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, আফগান সমাজের বহুত্ব অপূর্ব। কিন্তু সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে গভীর অবিশ্বাস আর বিভাজন এর অন্যতম প্রধান দুর্বলতার দিক। গত কয়েক শতাব্দী ধরে বাইরের শক্তিগুলো জাতিগত পার্থক্য, ধর্মীয় বিভিন্ন বিভেদকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ফায়দা নিয়েছে। সবশেষ ব্রিটিশ-মার্কিনীরাও একই কাজই করেছে।
তবে এটা তো ঠিক যে, আফগানিস্তানে থেকে তালেবানরা এই যুদ্ধে জিতেছে। নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করেছে, নেতৃত্ব পেয়েছে। এখন দেখার বিষয় বিভেদ বেড়ে ‘একচেটিয়া’ হয়, নাকি কমে দেশ-জাতি গঠনের দিকে এগিয়ে যায়?
যদিও একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার’ গঠনের সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি বলেই মনে করেন দেশটির সাংস্কৃতিক কমিশনের সহকারী প্রধান আহমাদউল্লাহ ওয়াসিক। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এখনো সব মন্ত্রণালয় এবং ডেপুটির নাম ঘোষণা করা হয়নি। তাই এই তালিকা আরও বাড়বে।’
প্রায় চার বছরের বেশি সময় আগে, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংস্থা ইউনাইটেড স্টেট ইনস্টিটিউট অব পিস আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতার বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ‘আফগানিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অ্যালেক্স থিয়ার এবং স্কট ওয়ার্ডেন মন্তব্য করেছিলেন, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং সংবিধানের পরিবর্তন ছাড়া আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখা এবং নিরাপদ রাজনৈতিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা কম।’
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার‘ গঠনের ক্ষেত্রে এটি আজও প্রাসঙ্গিক কি?