করাচির বাঙালি কাউন্সিলর রাশেদা : ‘আমার কথা কেউ শোনে না’

পাকিস্তানের করাচি শহরের মাচ্ছার কলোনির রাশেদা খাতুনের বয়স ৬০, তিনি একজন সাবেক কাউন্সিলর। শত শত মানুষকে তাদের পরিচয়পত্র পেতে সাহায্য করেছেন তিনি। কিন্তু তিনি এখন নিজের বা তাঁর সন্তানদের পরিচয়পত্রই বানাতে পারছেন না।
শোনা যাক তার কাহিনি :
‘আমি কাউন্সিলর হয়েছিলাম, কারণ এলাকার লোকজন বলতো রাশেদা বেশ সবল একজন নারী, যেখানেই কোনো বিবাদ লাগছে, সেখানেই ছুটে যাচ্ছে মিটমাট করতে। আট ভাইয়ের আমি ছিলাম একমাত্র বোন। আমাদের এলাকায় যখনই কোনো সমস্যা হতো, আমার বাবা সেটার মীমাংসা করতেন আর আমাকে পাশে বসে থাকতে বলতেন।
ছোটবেলা থেকেই আমি আমার চারপাশে কোনো অবিচার দেখলেই চুপ থাকতে পারতাম না, সেজন্যেই লোকে আমাকে ভোট দিয়ে কাউন্সিলর বানিয়েছিল।
আমি এখানে পাঁচ বছর কাজ করেছি। আমি এখানকার রাস্তা পাকা করতে সাহায্য করেছি, পাকা নর্দমা বানাতে সাহায্য করেছি। আর সবচেয়ে বড় কথা আমার সই করা কাগজ দিয়ে এখানকার লোকজন তাদের পরিচয়পত্র পেয়েছে।
কিন্তু এখন আমার নিজের পরিচয়পত্র আটকে আছে, আমার সন্তানদের পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিবেশিরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। বলে, একসময় তুমি না এখানকার সেরা কাউন্সিলরের ভাব নিতে!
আমার কাছে যে পরিমাণ কাগজপত্র আর প্রমাণ আছে, সেরকম পাকিস্তানে আর কারো নেই। প্রায় এক বস্তা। আমার নিজের কার্ড, আমার পুরোনো কার্ড, আমার স্বামীর কার্ড, জন্ম সনদ, আমার নির্বাচনী সার্টিফিকেট, আমার কাউন্সিলর কার্ড। বিভিন্ন সময় আমি যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিলাম সেসব দলের কার্ড।
আমাকে একবার গভর্নর হাউজেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেখানে আমাকে সম্মাননা জানানো হয়। আমার গলায় মালা পরিয়ে দেয়। গভর্নর হাউজে ঢোকার প্রবেশপত্রটি এখনো আমার কাছে আছে। পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) কাগজপত্র আছে। আছে আরো নানা কিছুর জন্য আবেদনপত্র দাখিল করার পর আমাকে যেসব টোকেন দেওয়া হয়েছিল সেগুলো। বুঝতেই পারছেন, প্রায় এক বস্তা কাগজ।
আমার তিনটা ছেলে, চতুর্থ জন মারা গেছে। পরিচয়পত্র নিয়ে হয়রান হতে হতে একটা ছেলের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। আমার চারটা মেয়ে, আছে আরো বহু নাতি নাতনি। সব মিলিয়ে আমাদের পরিবারে আমরা ৪৮ জন লোক।
একটা ছেলে মাদ্রাসায় পড়াত। এখন মাদ্রাসার লোকজনও পরিচয়পত্র চায়। কাজেই এখন সে বাড়িতে নিজেই একটা মাদ্রাসা খুলেছে।
গত মাসে আমার ছোট ছেলে একটা দুর্ঘটনায় পড়লো। ওর মাথা ফেটে গেছে। মাথার মগজ প্রায় বেরিয়ে এসেছিল। ওর অবস্থা ভালো হচ্ছিল, কিন্তু তারপর শীতকালে ওর ঠান্ডা লেগে গেল। এখানকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো ওকে, কিন্তু সেখানে প্রথমেই বলা হলো ওর পরিচয়পত্র কোথায়? আমাদের বলা হলো, পরিচয়পত্র দেখালে তারপরই ওকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর স্লিপ দেবে।
একটা স্ট্রেচারের জন্য যেতে হয়েছিল সাইলানি ট্রাস্টে। সেখানেও পরিচয়পত্র না দেখালে নাকি স্ট্রেচার দেয় না। আমার এক মেয়ের জামাইয়ের পরিচয়পত্র ছিল, আমি তাকে ডেকে আনলাম। তারপর আমরা জিন্নাহ হাসপাতালে ছুটলাম। ভাগ্য ভালো, এবার তারা পরিচয়পত্র দেখতে চাইল না।
আর কয়েক মিনিট দেরি হলে আমার ছেলে মারা যেত। আমার ছেলেমেয়েরাও এখন আমার ওপর ক্ষিপ্ত। কারণ আমি পরিচয়পত্র বানিয়ে দেওয়ার জন্য এক দালালকে এক লাখ রুপি দিয়েছি। আমি দালালকে বলেছিলাম, পরিচয়পত্র হাতে পেলে বাকি ৩০ হাজার রুপি দেব। এখন দালাল আর আমার ফোন ধরে না, মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
আমার ছেলেমেয়েরা বলে আমি নাকি পাগল, কীভাবে আমার সব সঞ্চয় আরেকজনের হাতে তুলে দিলাম। এখন আমরা কী করি? আমরা এখানে আটকে আছি। পরিচয়পত্র বানিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র আশাও যদি কোনো প্রতারক আমাদের দেখায়, আমাদের তার কথা শুনতে হয়।
মাঝে মাঝে ভাবি, এই সরকার আমাদের সবাইকে কেন জেলে ঢোকায় না। সেখানে অন্তত দিনে দুবার খেতে পারবো এবং কেউ আমাদের কাছে বার বার পরিচয়পত্র চাইবে না।
এই পরিচয়পত্র নিয়ে এত যন্ত্রণায় আছি যে মাঝেমধ্যে মনে হয়ে আত্মহত্যা করাই ভালো। কিন্তু তারপর ছেলেমেয়েদের কথা ভাবি। মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলে-মেয়ে সবাইকে নিয়েই আত্মহত্যা করি, তাহলে সবাই শান্তি পাব।
প্রতিবেশীরা আমাকে সম্মান করে, তারা তাদের বিচার-আচারের জন্য আমার কাছে আসে। আমি যখন থানায় যাই, পুলিশ আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়।
আমার শেষ ও একমাত্র ইচ্ছে- আমার যখন পরিচয়পত্র হবে, তখন আমি সৌদি আরবে যাব হজ করতে। কিন্তু আমি যদি এখন যে অবস্থায় আছি সেভাবেই মারা যাই, তাহলে সারাজীবন ধরে আমার অভিশাপ পড়বে নাডরা (ন্যাশনাল ডাটাবেজ অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি) আর সরকারের ওপর।’