ভালোবাসার খেসারত!
অপরাধ ভালোবাসার। অপরাধ মুসলিম হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলেকে বিয়ে করার। যে কারণেই গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরদের নির্দেশে সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে একঘরে করা হয়েছে একটি মুসলমান পরিবারকে। বেদনাদায়ক এ ঘটনা ঘটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায়।
পুরাতন মালদা ব্লকের যাত্রাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের মেহেরপুর গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় বামনগোলা ব্লক দপ্তরের সরকারি কর্মচারী কোবাদ আলী তাঁর মেয়ের ভালোবাসার মূল্য দিতে গিয়ে গ্রাম্য শালিসি সভার রোষানলে পড়েছেন। মালদা শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরের মেহেরপুর গ্রামে বসবাস করেন কোবাদ আলী এবং মানুয়ারা বিবি। তিন মেয়েকে নিয়ে মোটের ওপর সুখের সংসার ছিল তাঁদের। ছোট দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে। কোবাদ আলী গ্রাম্য মাতব্বরদের রক্তচক্ষুর সামনে পড়েছেন বড় মেয়েকে নিয়ে। মাতব্বরদের কথায়, বড় মেয়ে হিন্দু বামুনের ছেলেকে বিয়ে করায় জাতের সর্বনাশ হয়েছে!
কোবাদ আলীর ছোট দুই মেয়ের বিয়ে আগে হয়ে গেলেও বড় মেয়ে কাকলি খাতুন সব শেষে ভালোবেসে বিয়ে করেন কোচবিহার জেলার দিনহাটা ব্লকের বাসিন্দা বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে। যে বিয়েতে বিশ্বজিতের পরিবার আপত্তি তুললেও আপত্তি তোলেননি কোবাদ আলীর পরিবার। কোবাদ আলীর কথায়, ‘মেয়ের ভালোবাসার মূল্য দিয়েছি আমরা। ওরা যদি ভালোবেসে বিয়ে করে সুখী হয় তাহলে তার থেকে বড় আনন্দের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।’
কোবাদ আলীর সিদ্ধান্তের কারণেই গ্রামের হিন্দু ও মুসলিম মাতব্বরা জাত গেল বলে আসরে নেমে পড়েন। কোবাদ আলীর পরিবারকে তাঁরা একঘরে করে দিয়েছেন। তবে ভালোবেসে মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে ভোগান্তি কম জোটেনি বিশ্বজিতেরও। বিয়ের পর কাকলিকে নিয়ে দিনহাটায় বিশ্বজিৎ থাকতে শুরু করলেও এলাকাবাসীর চাপে একসময় এলাকা ছাড়তে হয় তাঁর। পেশায় বেসরকারি সংস্থার কর্মী বিশ্বজিতের স্বজনরা তাঁকে পরিত্যক্ত করেন। পরিস্থিতি আঁচ করে কোবাদ আলী উদ্যোগী হয়ে মেয়ে-জামাইকে দিনহাটায় একটি বাড়িও বানিয়ে দেন। কিন্তু এলাকাবাসীর চাপে সেই বাড়িতেও থাকতে পারেননি বিশ্বজিত-কাকলি। বাধ্য হয়ে মাস তিনেক আগে কোবাদ আলী মেয়ে-জামাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। বর্তমানে কাকলি অন্তঃসত্ত্বা। এদিকে বাড়িতে হিন্দু জামাই জানতে পেরে কোবাদ আলীর পরিবারকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করে এলাকাবাসী। ক্রমেই পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে শুরু করে। হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের এক শ্রেণীর মোড়লরা এসে বাড়িতে ঢুকে কাকলিকে মারধর করে যায়। যা নিয়ে মালদা থানায় অভিযোগও দায়ের হয়। কিন্তু দোষীদের কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। ফলে গ্রাম্য মোড়লদের দুঃসাহসের মাত্রা আরো বেড়েছে। সম্প্রতি এক শ্রেণীর গ্রামবাসীর মধ্যমে কোবাদ আলীর পরিবারের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালাচ্ছেন গ্রামের মোড়লরা।
ধর্মের জিগির তুলে ভিন সম্প্রদায়ের বিয়েকে ধর্মীয় অনুশাসনের সুড়সুড়ি দিয়ে গ্রামে শালিসি সভাও বসান তাঁরা। যদিও কোবাদ আলী সেই শালিসি সভাতে যাননি। এই ধরনের গ্রাম্য শালিসি সভার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি। আর এতেই বেজায় চটেছেন গ্রামের মোড়ল-মাতব্বররা। কোবাদ আলীর ওপর নেমে এসেছে শাস্তির খাঁড়া। গত ১০ মে থেকে কোবাদ আলীর পরিবারের প্রতি সামাজিক বয়কট করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে বর্তমানে একঘরে হয়ে রয়েছে কোবাদ আলীর পরিবার। গ্রামের কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলে না। গ্রামের কোনো দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারেন না। কল থেকে পানি সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও আরোপ করা হয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা। এমনি কোবাদ আলী বাড়ির পানি যাতে বাইরে না বের হয় তার জন্যও আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে হ্যাঁ। কোবাদ আলীর এই একঘরে অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার বিকল্প নিদানও দিয়েছেন গ্রামের মোড়ল-মাতব্বররা। তাঁরা জানিয়েছেন, কোবাদ আলী মোটা টাকা জরিমানা দিলেই এই সামাজিক বয়কট উঠিয়ে নেওয়া হবে।
তবে গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরদের এই ঘটনায় শিক্ষিত কোবাদ আলীর পরিবার আইনের দ্বারস্থ হয়েছে। গ্রামের কিছু মানুষ তাঁদের এভাবে উৎখাত করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কোবাদ আলী। তাঁর স্ত্রী মানুয়ারা বিবি গোটা ঘটনায় গত ১৭ জুন গ্রামের ৯ জন মোড়ল-মাতব্বর ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গোদের বিরুদ্ধে পুরাতন মালদার বিডিওর কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। তবে গোটা ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কে কোবাদ আলীর পরিবার। এই ঘটনায় কোবাদ আলীর বড়মেয়ে কাকলি খাতুন (২৬) জানিয়েছেন, তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই বিশ্বজিৎকে বিয়ে করেছেন। তবে তাঁর জন্য এভাবে গোঁড়ামি-কুসংস্কার এবং এক শ্রেণির স্বার্থবাদী মানুষের রোষানলে পড়বে ভাবেননি। তবে গোটা ঘটনায় পুরাতন মালদার বিডিও দুলেন রায় বলেছেন, ‘অভিযোগপত্র পেয়েছি। মালদা থানায় বিষয়টি জানানো হয়েছে।’ স্থানীয় বিধায়ক ভুপেন্দ্র নাথ হালদার জানান, এই ধরনের অমানবিক ঘটনার বিরুদ্ধে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।