সু চি-মোদির বৈঠকে আসবে রোহিঙ্গা ইস্যু
রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়ে লাখো রোহিঙ্গা মুসলমান যখন জীবন বাঁচাতে বিপদসংকুল নদী ও সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, ঠিক সে সময়েই মিয়ানমারে এক গুরুত্বপূর্ণ সফরে গেলেন প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আজ বুধবার বিকেলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতা ও ডি-ফেক্টো লিডার অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে নরেন্দ্র মোদির। সেখানে সীমান্ত নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুটি গুরুত্ব পাবে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে দুদিনের সফরে মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিডোতে পৌঁছান নরেন্দ্র মোদি। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হি থিন কাউয়াই। পরে দুই নেতা বৈঠক করেন। বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদি টুইটে বলেন, ‘হি থিন কিউয়াওয়ের সঙ্গে চমৎকার বৈঠক হয়েছে।’
দিল্লিভিত্তিক গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের প্রায় এক হাজার ৬৪৩ কিলোমিটারের সীমান্ত পথ রয়েছে।
দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চার রাজ্য এই সীমান্ত পথের সঙ্গে যুক্ত। কয়েকশ বছরের বাণিজ্য-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ধারাবাহিকতাতেই এখনো ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় ২০ লাখ নাগরিক বাস করেন মিয়ানমারে।
দুই দেশের সীমান্তরেখা বরাবর মিয়ানমার অংশে ‘বিদ্রোহীদের’ তৎপরতা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি ভারতের প্রচুর বিনিয়োগও রয়েছে দেশটিকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে মিয়ানমারের কালাদান নদীর ওপর সেতু, সমুদ্রপথের বিনিয়োগ, মিজোরাম ও রাখাইনের মধ্যে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে অর্থ ঢালছে ভারত।
এত কিছুর পর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ভারতের কাছে মিয়ানমারের ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। ভারতের ‘পূর্বমুখী’ নীতির ‘প্রথম দ্বার’ হচ্ছে মিয়ানমার, অন্যদিকে চীনের প্রভাববলয়ে থাকা মিয়ানমারকে নিজের পক্ষে টানতে মোদির সফর বিশেষ গুরুত্ব রাখবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সংঘাতপ্রবণ রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে ১৬ হাজার জাতিসংঘের নিবন্ধিত শরণার্থী। ভারত এসব রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে তৎপর। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আজকে সু চির বৈঠকে সে ইস্যু প্রাধান্য পাবে বলে আভাস দিয়েছেন ভারতের কর্মকর্তারা।
গতকাল ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজেজু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিহ্নিতকরণের কাজ শেষ হলেই ভারত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চায়।’
ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, গত মাসেই কিরেন রিজেজু সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে জানিয়েছিলেন, তাঁর দেশে থাকা ৪০ হাজার রোহিঙ্গার অধিকাংশই অবৈধভাবে জম্মু, হরিয়ানা, হায়দরাবাদ, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।
নতুন করে সহিংসতা সৃষ্টির পর মিয়ানমার থেকে ১১ দিনে এক লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি ও রয়টার্স। সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে গতকাল তিন হাজার ২৩১ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। আর মিয়ানমারের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পুরো মিয়ানমারেই মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে।
মিয়ানমারের চলমান সেনা অভিযান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, রোহিঙ্গারা ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার পথ ছয় দিন ধরে পাড়ি দিয়ে নিরাপত্তা পেতে আসছে বাংলাদেশে। তারা খাদ্য ও পানীয় সংকটে রয়েছে।
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের’ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এই হামলার দায় স্বীকার করে। এ ঘটনার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। সেখান থেকে পালিয়ে আসার রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্বাচারে গ্রামের পর গ্রামে হামলা নির্যাতন চালাচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করছে। গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে জাতিসংঘ গত ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দুজন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ সাধারণ নাগরিক।
মিয়ানমার সরকারের আরো দাবি, ‘বিদ্রোহী সন্ত্রাসীরা’ এখন পর্যন্ত রাখাইনের প্রায় দুই হাজার ছয়শ বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এখনো রাখাইন রাজ্যে থাকা মুসলিমদের মধ্যে মাইকে প্রচার চালাচ্ছে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।