সৌদি বাদশাহর ঝামেলার বছর
জানুয়ারিতে সৎভাইয়ের কাছ থেকে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে সৌদি আরবের ৭৯ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ সাহসিকতা দেখাচ্ছেন। নতুন কোনো বাদশাহর ওপর দুর্ভাগ্য নেমে আসতেই পারে, তবে সালমানের যন্ত্রণাগুলো নিরাময়যোগ্য নয়। দেশটিতে ক্রমেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে; স্বচ্ছতার অভাব ও নেতৃত্বের ত্রুটি-বিচ্যুতির ফলস্বরূপ ব্যর্থ শাসন ব্যবস্থার ফল এটা।
গত ১১ সেপ্টেম্বর মক্কায় মসজিদ আল হারামে ক্রেন ভেঙে শতাধিক মানুষের মৃত্যু অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা হতে পারে। তবে ২৪ সেপ্টেম্বরের পদদলনে ৭৬৯ হাজির মৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিক নয়, এটা হজ চলাকালীন মানুষের মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনার একটি; এ থেকে বোঝা যায় ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থানকে নিরাপদ করতে সৌদির প্রচেষ্টা ব্যর্থ। ‘দুই পবিত্র মসজিদ রক্ষাকারী’ হিসেবে অভিহিত বাদশাহ সালমানের জন্য এটা বিব্রতকর। তবে দায়িত্বশীল সৌদি সংবাদপত্রগুলো রাজপরিবারের একটি টেলিগ্রাম প্রকাশ করেছে, যা যুবরাজ মুহাম্মদ বিন নায়েফকে লেখা। এতে সফল কাজের জন্য বাদশাহ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রশংসা করেন। বিন নায়েফ হজ আয়োজক কমিটির সভাপতি।
ইয়েমেনে সৌদি আরবের যুদ্ধে মানবিক বিপর্যয় নিয়ে নির্বিকার আছে রাজ্য। জাতিসংঘের হিসেবে অন্তত সাড়ে চার হাজার মানুষ এ যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে বেশি বেসামরিক নাগরিক। গত মার্চে আধা-শিয়াপন্থী হুথি বিদ্রোহীদের দমন করতে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে হামলা শুরু করে। সর্বশেষ গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিমান হামলায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া অন্তত ১২৮ জন নিহত হয়। এটা অসংখ্য ঘটনার মাত্র একটি। সৌদি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র এখন পর্যন্ত দায় অস্বীকার করেছে।
ইয়েমেন একটি স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ দেশটিতে হামলাকারী জোটের কমান্ডার সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান, যিনি বাদশাহ প্রিয়পুত্র। এখন পর্যন্ত ইয়েমেনে হামলায় সৌদি জনগণের সমর্থন রয়েছে। তবে ইয়েমেনের সমতলে সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনী জয় পেলেও দুর্গম পাহাড়ি ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে অভিযান চালালে মৃত্যু ও জনগণের সংশয় বাড়বে, আর এসব অঞ্চলেই বিদ্রোহীদের অবস্থান।
বাদশাহর ছেলের এরই মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এটা বোঝা যায়, এক যুবরাজের দুটি চিঠি থেকে, যেগুলো এরই মধ্যে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই যুবরাজ লেখেন, ‘কিশোর ও অসহিষ্ণু লোকের হাতে আমাদের ভাগ্য জিম্মি, আমরা এটা কীভাবে গ্রহণ করব?’ তিনি জ্যেষ্ঠ যুবরাজদের এক জায়গায় জড়ো হয়ে আরো যোগ্য নেতা নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের বয়স মাত্র ৩০।
অনেক সৌদি নাগরিক এই চিঠিগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এগুলো ভিন্নমতাবলম্বীদের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়িয়ে পড়ে। চিঠির লেখক নিজেকে সৌদির প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের পৌপুত্র হিসেবে দাবি করেন। ১৯৫৩ সালে আবদুল আজিজের মৃত্যু হয়। এই চিঠি লেখক আল সৌদ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের কয়েকশ যুবরাজের কেউ হবে। চিঠিতে সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি, তবে আরো রক্ষণশীল পথে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ওয়াহাবি আলেমদের সঙ্গে পুনরায় জোটবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে এই জোট নিয়ে সৌদির নাগরিকরা প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ ইসলামিক স্টেটের রক্তাক্ত উত্থান ভয়ংকর মতবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিজ ভূমিতেই বিপদ ডেকে এনেছে। ইসলামিক স্টেট ওয়াহাবি মতবাদ থেকে মতাদর্শ গ্রহণ করেছে। শরিয়ার কঠোর ব্যাখ্যা দিয়ে রাজ্য এক শিয়া যুবককে ক্রুশ দিয়ে ও শিরশ্ছেদ করে হত্যা করলে পশ্চিমা দেশগুলো এর সমালোচনা করে, সৌদির অধিবাসীদেরও এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। রাজ্যের শিয়া মসজিদগুলোতে বোমা হামলার পর এক সেনা কর্মকর্তাকে খুনের ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন তোলে। ‘ক্রুসেডারদের (আমেরিকান) রক্ষাকারী’ হওয়ায় ওই কর্মকর্তাকে তাঁর দুই চাচাতো ভাই সানন্দে গলা কেটে খুন করে, এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে।
তবু এসব সুপ্ত অসুস্থতা সৌদি নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করবে কি না সন্দেহ, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গত বছর তেলের দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি সরকারকে ধাক্কায় দেয়, যদিও এর পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ (রিজার্ভ) রয়েছে। এই রিজার্ভ গত বছর ছিল ৭৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এ বছর ১০ শতাংশ কম। সাধারণ সৌদি নাগরিকদের জন্য যা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো এর স্টক মার্কেট। গত বছরের তুলনায় স্টক মার্কেটের ৩০ শতাংশ পতন হয়েছে। এমনকি গত জুনে এই বাজার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য খুলে দেওয়া হলেও কাজ হয়নি।
দ্রষ্টব্য : লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ‘সৌদি অ্যারাবিয়া: কিং সালমানস ইয়ার অব ট্রাবল’ নিবন্ধ থেকে অনূদিত। লেখাটি ৩ অক্টোবর, ২০১৫ ছাড়া সংস্করণে প্রকাশিত হবে।