৪০ বছরেই সাগর শুকিয়ে মরুভূমি
কোজাবে একজন জেলে। কিন্তু থাকেন মরুভূমিতে! শুধু কোজাবেই নন, তাঁর গ্রামের প্রায় সবাই এক মাছধরাকে বেছে নিয়েছিলেন জীবিকা হিসেবে। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে তাঁদের মাছ ধরার বিচরণক্ষেত্রগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। মাছগুলো মরে যেতে থাকে। পরের ৪০ বছরে শুকিয়ে যায় তাদের জীবিকার উৎস অ্যারাল সাগর। মরুভূমি গ্রাস করে নেয় প্রায় ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সাগরটি!
কাজাকিস্তানের অ্যারাল সাগর কোথাও কোথাও ছিল ৪০ মিটার পর্যন্ত গভীর। বিপুল এই জলরাশি বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে!
মধ্য এশিয়ার এই অ্যারাল সাগর, আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ। কাস্পিয়ান সাগর, লেকস সুপেরিয়র ও ভিক্টোরিয়ার পরই তার স্থান। কিন্তু এখন তার ১০ ভাগও অবশিষ্ট আছে কি না, সন্দেহ। গত কয়েক দশকের মধ্যে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম নাটকীয় ঘটনা।
কোজাবের গ্রাম, কাজাকিস্তানের জালানাস এলাকাটি ছিল এই অ্যারাল সাগরের উত্তরবর্তী কূলে। এখন সেখানে কোথাও পানির দেখা নেই। যেদিকে দুচোখে যায়; শুধু বালি আর বালি। নিজের চারপাশটা দেখিয়ে কোজাবে বলেন, 'একটু সামনেই ছিল সাগরটা। আমরা গিয়ে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। একটা সৈকত ছিল। সেখানে বাচ্চারা রৌদ্রস্নান করত।'
সমুদ্রের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য এখনো আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক মাছধরার ট্রলার, নৌকা। একটা বড় নৌকা দেখিয়ে ৮৬ বছর বয়সী কোজাবে জানান, সেটাতে ২০ থেকে ৪০ জন মানুষ উঠতে পারে। তিনি বলেন 'এখানে জেলেরা থাকত, পাচক থাকত, নাবিক, প্রকৌশলী থাকত। কিন্তু সাগর যখন শুকিয়ে যেতে থাকল, তখন নৌকাগুলো আর কম জলের বন্দরে ভিড়তে পারত না। এক এক করে সেগুলো আটকে যেতে থাকল নরম কাদার মধ্যে। আর সেই কাদাই এখন পরিণত হয়েছে এই বালিতে।'
এই অ্যারাল সাগর থেকে কোজাবেরা এত মাছ ধরতেন, যা দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার ছয়ভাগের একভাগ মাছের চাহিদা পূরণ হতো। একবারের খ্যাপে ৪০০ কেজির বেশি মাছও ধরেছেন কোজাবে। সাত কেজি ওজনের মাছও ধরা পড়েছে কোজাবের জালে। কিন্তু ১৯৭৬ সালে কোজাবের জালে উঠে আসে এক ঝাঁক মরা মাছ। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকায় কোজাবের মতো অনেকেই পাড়ি জমান অন্যত্র।
অ্যারাল সাগরের এই বাঁচা-মরার প্রশ্নটি কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়নি। এটা মনুষ্যসৃষ্ট কিছু মুনাফা সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ পরিণতি। সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে আছে ভূ-রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ।
মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই নদীর জলধারা এসে মিশত অ্যারাল সাগরে। উত্তর থেকে সির ডারয়া ও দক্ষিণ থেকে আমু ডারয়া। এই দুই নদীই পড়েছে কাজাকিস্তানের প্রতিবেশী উজবেকিস্তানের বাধার মুখে।
১৯৭০, ৮০-র দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার তুলা-শিল্পের বৃহত্তম ক্ষেত্র ছিল উজবেকিস্তান। মধ্য এশিয়াকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তুলা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। ৮০-র দশকে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি তুলা উজবেকিস্তানেই উৎপাদিত হয়েছে। উজবেকিস্তান এখনো আছে তুলা উৎপাদনকারী শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে।
বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক কারণে গড়ে ওঠা সেই তুলার জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে গিয়ে থমকে গেছে অ্যারাল সাগরের দুই সখা-নদী সির ডারয়া এ আমু ডারয়ার জলপ্রবাহ।
পামির পর্বতমালা থেকে ২৪১৪ কিলোমিটার লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসা আমু ডারয়া নদীর বৃহদাংশই শুষে নেয় উজবেক তুলা চাষের জমিগুলো। বিগত পাঁচ বছর ধরে এটা অ্যারাল সমুদ্র পর্যন্ত এসে পৌঁছাতেও পারছে না। ঠিক কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে সেটা জানাও যায়নি। কারণ উজবেক কর্তৃপক্ষ এটা প্রকাশ করতে চায় না।
এককালে মহাবীর আলেক্সান্ডার যে নদীকে বর্ণনা করেছিলেন তাঁর দুর্ধর্ষ সেনাদলের জন্য একটা দ্রুত-বহমান বাধা হিসেবে, সেই সির ডারয়া নদীর প্রবাহও অনেক কমে গেছে। এককালে যেখানে থৈ থৈ করত বিপুল জলরাশি, সেটা প্রথমে ভাগ হয়ে যায় দুইটা লবণাক্ত হ্রদে। দক্ষিণে বড় অ্যারাল। সেটার অর্ধেক অংশ আছে উজবেকিস্তানে। আর কাজাকিস্তানে আছে ছোট অ্যারাল। বড় অ্যারালটাও আবার পরবর্তীতে ভাগ হয়ে যায় পূর্ব ও পশ্চিম বেসিনে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে এই পূর্ব বেসিনও পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে।
মধ্য এশিয়ার স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা আমু ডারয়া নদীকে চিনত এই অঞ্চলের আমাজন হিসেবে। এমন প্রমত্ত একটা নদীর ধারা রোধ করা হয়েছে তুলা ও ধানক্ষেতে সেচ দেওয়ার কাজে। লাখো মানুষের জীবনও জড়িয়ে আছে এই চাষবাষের সঙ্গে। সেটা বাধাগ্রস্ত করাও সম্ভব না বলে মন্তব্য করেছেন সেভ দ্য অ্যারাল সি ফাউন্ডেশনের প্রধান মেদাদ অসপানোভ, 'আপনি যদি পুরো অ্যারাল সমুদ্রকে বাঁচাতে চান তাহলে এই অঞ্চলে (উজবেকিস্তানে) সেচকার্য বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এটা হবে অসম্ভব।'
তবে নদীগুলো বাঁচানোর জন্য উজবেক সরকারের আন্তরিকতা ছিল না বলেও অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। কারণ শুকিয়ে যাওয়া সাগরের বুকে পাওয়া গেছে তেল ও গ্যাসের সন্ধান। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজে জলের নিচের চেয়ে শুকনো জায়গাতেই বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। রাশিয়ান ও কোরিয়ান কিছু এনার্জি কোম্পানি ইতিমধ্যে তাদের কাজ শুরুও করে দিয়েছে।
সাগর বাঁচানোর চেয়ে মরুভূমির আশপাশ বসবাসরত মানুষদের জীবনযাত্রার মান কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছে উজবেক সরকার। তাদের নেওয়া একটা পদক্ষেপ হলো শুকিয়ে যাওয়া সমুদ্রের বুকে সাক্সাউল গাছ রোপন। এগুলো পরিবেশে বিষাক্ত লবণাক্ত উপাদান ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা কমাতে সহায়তা করবে। আর দ্বিতীয়টি হলো : মাছ ধরার উপযোগী কিছু লেক বানানো। এই প্রস্তাব দিয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থসাহায্যও আশা করে উজবেকিস্তান।