বাড়ছে নিষেধাজ্ঞা, বাড়ছে অসহিষ্ণুতা
‘খেয়ো না, পড়ো না, দেখো না, অনুভব করো না’—‘জাস্ট বিপ ইট’! কিংবদন্তি পপ গায়ক মাইকেল জ্যাকসনের একটি বিখ্যাত গানের অনুকরণে গাইছেন এক তরুণী। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রক্ষণশীল সরকারের নিষিদ্ধের তালিকায় ‘উপভোগ করা যাবে না’ এমন বিষয়গুলোর দিকেই গায়িকার ইঙ্গিত।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত বরাবরই শৈল্পিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে।
গো-মাংস ভক্ষণ থেকে শুরু করে হালের বিতর্কিত হলিউড ছবি ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’—নিষিদ্ধের তালিকা যতই বাড়ছে, বর্তমান হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে জনমনে অসহনশীলতার মেঘও দিন দিন জমাট বাঁধছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্জালের এই যুগে অল্পতেই গায়ে ফোস্কা পড়া এসব রাজনীতিকের ‘ক্ষতিকর’ ব্যাপারগুলো জোর করে বন্ধ করার চেষ্টা উল্টো বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, মাইকেল জ্যাকসনের কালজয়ী গান ‘বিট ইট’-এর ব্যাঙ্গাত্মক এই সংস্করণ তৈরি করেছে ভারতের কমেডি-ত্রয়ী ‘এন্না দা রাসকালাস’। গত সপ্তাহে ইউটিউবে ঝড় তোলা গানটিকে সরকারের কালো তালিকার বিরুদ্ধে জুতসই জবাব হিসেবে দেখছেন অনেকেই।
দিল্লিতে ২০১২ সালে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে এ মাসের গোড়ার দিকে বিবিসির একটি তথ্যচিত্র ভারতে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টে বলেন, তথ্যচিত্রটিতে ধারণ করা ধর্ষকের মন্তব্য জনগণকে খেপিয়ে তুলতে পারে।
এর কিছুদিন পরেই যৌনতার দোহাই দিয়ে হলিউড ছবি ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’ ভারতে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে দেশটির সেন্সরবোর্ড, যদিও সিনেমাটিকে কাটছাঁট করেই দেখানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছিল।
এ ছাড়া ‘রোস্ট’ নামে একটি কমেডি শোতে প্রচারিত কয়েকজন বলিউড তারকার আদিরসাত্মক কৌতুক ইউটিউবে প্রকাশ হওয়ার পর তাঁরা অশ্লীলতার অভিযোগে তদন্তের মুখে পড়েছেন।
হরিয়ানা প্রদেশের বাসিন্দা সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন মন্তব্য করেন, ‘সরকারের ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাই যেকোনো সমস্যার দ্রুততম সমাধান।’
বিশৃঙ্খলা রুখতেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, কিন্তু বিতর্ক-বিশৃঙ্খলা বাদ দিয়ে মুক্ত গণতন্ত্র পাওয়া সম্ভব নয়। এটি জীবনকে আরো জটিল করছে।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা কেন্দ্রীয় ডানপন্থী দল কংগ্রেসেরও আমলে, বিশেষ করে ১৯৭৫-৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর অধীনে ‘জরুরি অবস্থা’ চলাকালীন ‘নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
যার উদাহরণ, ১৯৮৮ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি ইসলাম অবমাননার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়।
তবে দুই দশক ধরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখা যায়। টিভি চ্যানেলগুলো সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটির মতো ‘চপল’ সিরিজ প্রচার করতে পারছিল।
এমনকি, ২০১৩ সালে ভারতে মুক্তি পায় রুশদির ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র, যেখানে ‘জরুরি অবস্থার’ কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। যদিও ছবির নগ্নতা দোষে দুষ্ট অংশগুলো বাদ দেওয়া হয়।
অসহিষ্ণুতার ঘনঘটা
কংগ্রেসের পার্লামেন্ট সদস্য ও লেখক শশী থারুর বলেন, গত মে মাসে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের হাওয়া বদলে গেছে।
শশী থারুর বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অসহিষ্ণুতাকে লাগামহীনভাবে বাড়তে দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে আমরা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন।’
‘ভারতের মূলস্রোত, যাদের সব সময় বিচ্ছিন্ন মতাদর্শের ধারক হিসেবেই দেখে আসছে, তারাই আজ হঠাৎ করে ক্ষমতাসীনদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।’ বলেন শশী থারুর।
১৯৮৯ সালে সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতের বিদ্রূপাত্মক ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল’ লিখে আলোচনায় আসা প্রাক্তন এই কূটনীতিক সংশয় প্রকাশ করে বলেন, এ সময়ে যদি বইটি প্রকাশিত হতো, তবে হয়তো তা নিষিদ্ধ হতো।
গেল জানুয়ারিতে কট্টরপন্থী হিন্দু ও বর্ণ সমর্থক গোষ্ঠীর তোপের মুখে পড়ে লেখালেখিই ছেড়ে দিয়েছেন পাঠক আদৃত তামিল ভাষার লেখক পেরুমাল মুরুগান। তাঁর লেখা একটি বইয়ের কারণে অপমানিত বোধ করে ওই সব গোষ্ঠী।
কট্টরপন্থী কয়েকটি হিন্দু গোষ্ঠীর চাপে চলতি মাসে মহারাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর মুম্বাইসহ প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে গো-মাংস নিষিদ্ধ করা হয়। হিন্দুরা গরুকে পবিত্র মনে করে।
ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি প্রচুর মুসলমান, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সংখ্যালঘুর বসবাস, সেখানে এমন সিদ্ধান্তকে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির আরেকটি চিহ্ন হিসেবে দেখছেন অনেকেই।
তবে ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করা পবন ভার্মা মনে করেন, নানা মত-গোষ্ঠীর এই দেশে অপরাধপ্রবণতা এড়ানোর জন্য ক্ষেত্রবিশেষে বিধিনিষেধের প্রয়োজন রয়েছে বৈকি।
সহাবস্থান
‘ভারত হলো ব্যাপক সামাজিক অসংগতিপূর্ণ এমন একটি দেশ, যেখানে একে অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান করার চেষ্টা করছে আর সবাইকে সব সময় খুশি রাখা মোটেই সহজ কাজ নয়।’
মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কার্টুন প্রকাশের জেরে গত জানুয়ারিতে প্যারিসের বিদ্রূপাত্মক ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর কার্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় ভারতে ব্যাপক নিন্দা করা হয়।
কিন্তু যখন মুম্বাইভিত্তিক একটি উর্দু ম্যাগাজিনের সম্পাদক সহমর্মিতা দেখিয়ে সেই কার্টুনগুলো তাঁর ম্যাগাজিনে ছাপান, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত এআইবি (All India Bakchod)-এর কৌতুকশিল্পী তন্ময় ভাট বলেন, ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করার যে হিড়িক পড়েছে, তার যৌক্তিকতা সামান্যই; কিন্তু এটি অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রতিফলন।
‘আমাদের অবস্থা হচ্ছে সেই উটপাখির মতো।’ গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন তন্ময় ভাট। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বালিতে মাথা ডুবিয়ে ভাবছি, আমার যা পছন্দ নয়, তা নিজ থেকেই চলে যাবে।’