বাংলাদেশের কেউ আসেনি, যেন আমার অস্তিত্ব নেই
সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিমের এক শহরে জনাকীর্ণ রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করলেন মধ্যবয়সী এক নারী, তাঁর হাতে ব্যান্ডেজ, একটি বুড়ো আঙুল নেই। পাশেই বাচ্চারা রঙ-পেন্সিল খেলছিল। ছিল পরিচারকদের ছোটাছুটি।
বিকলাঙ্গ এই নারী রাফিদা আহমেদ (বন্যা), ঢোকার সময় পুরো কামরাটি সতর্কভাবে দেখে নিলেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ইসলামি জঙ্গিদের থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন আটলান্টার এই ফিন্যান্সিয়াল নির্বাহী, বাংলাদেশে সেদিন তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায় জঙ্গিরা। এই হামলায় তাঁর স্বামী বাংলাদেশি-আমেরিকান ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বন্যার মাথায় চারটি আঘাত লাগে এবং তাঁর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ৩ মে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার প্রধান এই হামলার দায় স্বীকার করেন।
হামলার পর প্রথম বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে বন্যা তাঁর স্বামীকে হত্যার জন্য জোরালো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, 'এটা ছিল সূক্ষ্ণ সুপরিকল্পিত-বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের কর্মকাণ্ড।
বন্যা বলেন, 'তবে যে বিষয়টি আমাকে পীড়া দেয় তা হলো, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কেউই আমার কাছে আসেনি। যেন আমার কোনো অস্তিত্বই নেই, এবং তারা জঙ্গিদের ভয় পায়। বাংলাদেশ কি পরবর্তী পাকিস্তান বা আফগানিস্তান হতে যাচ্ছে?'
একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, তাঁর মা অভিজিতের পরিবারকে একান্তভাবে সমবেদনা জানিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতই অস্থির যে, তিনি এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেননি বলেও তিনি জানান।
জয়কে ক্ষমতাসীন পার্টি আওয়ামী লীগের অনানুষ্ঠানিক উপদেষ্টা উল্লেখ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, 'আমরা একটি সূক্ষ্ণ রেখায় হাঁটছি। আমরা চাই না লোকজন আমাদের নাস্তিক বলুক। এতে আমাদের গভীর বিশ্বাসের পরিবর্তন হবে না। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় (সেক্যুলারিজম) বিশ্বাস করি।' তিনি বলেন, 'কিন্তু যেহেতু আমাদের বিরোধী দল আমাদের বিপক্ষে ধর্মের কার্ড ব্যবহার করে, সে কারণে আমরা তাঁর (অভিজিৎ) পক্ষে জোরালোভাবে প্রকাশ্যে আসতে পারি না। ব্যাপারটা চেতনার, বাস্তবতা নয়।'
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মুখপাত্র শামীম আহমেদ জানান, তিনি জানেন না কেন তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে রাফিদার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।
শামীম বলেন, 'আমরা অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের জন্য শোকাহত এবং এই জঘন্য কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি।' তিনি বলেন, 'জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং এটা ধ্বংস করতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) এক মুখপাত্র জানান, ঢাকায় তাদের এজেন্ট মোতায়েন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। বন্যা জানান, এফবিআই এজেন্টরা গত শুক্রবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, এমন এক সময় অভিজিৎ খুন হলেন যখন ঢাকার বাসে বোমা হামলায় ১৬০ নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর কিছু পরই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে পাশে বিস্ফোরণ ঘটে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করে জয় বলেন, মায়ের সরকারকে তারা অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
'আমাদের কাছে অভিজিতের মৃত্যু অন্য ১৬০ জনের থেকে আলাদা নয়। আমরা সব হত্যাকারীদের বিচার করতে চাই। আমি বুঝতে পারি, কেন তিনি (বন্যা) হতাশ। আমরা মাও এই মৌলবাদীদের লক্ষ্যবস্তু,' যোগ করেন জয়।
যুক্তরাজ্যের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টায় ২০০৬ সাল থেকে বাস করছিলেন বন্যা ও অভিজিৎ। বাংলাদেশে পরিচিত হলেও অভিজিৎ আটলান্টায় ছিলেন অপরিচিত। দিনের বেলায় তিনি যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ভেরিজনে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন। রাতে তিনি প্রচুর লিখতেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের নেতৃত্বস্থানীয় সমালোচক ছিলেন। অভিজিৎ আটটি বই লিখেছেন। মুক্তমনা নামের ব্লগ সম্পাদনা করতেন।
অভিজিতের সৎমেয়ে ত্রিশা আহমেদ (১৮) বলেন, 'আমার বাবা এমন একটি সমাজ নির্মাণ করছিলেন যেখানে সবাই যৌক্তিকভাবে চিন্তা করবে। তিনি একটি আলোচনা শুরু করতেন, দেখতেন এটা কোথায় যায়।'
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ গঠনের শুরুতে অভিজিৎ ছিলেন শিশু। যুদ্ধের মূলে ছিল ঔপনিবেশিকতাবাদ ও ধর্ম। যদিও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তরেখা নেই, ছিল না ভাষার মিলও। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ বিভক্ত করে। এই ভাগ মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে : পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বসবাসরত বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম।
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৯০-এর দশক থেকে ইসলামি মৌলবাদীরা এই দেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। কারণ আরবের ধনী ব্যক্তিরা এখানে ধর্মীয় বিদ্যালয় (মাদ্রাসা) নির্মাণ করে দেয়। ওই কর্মকর্তারাই জানান, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে শ্রমিক কাজ নিয়ে যান বাংলাদেশিরা, তারা দেশে ফিরে আসেন কঠোর ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এ কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশি-ব্রিটিশ অ্যাক্টিভিস্ট রায়ান রশিদ বলেন, স্নাতক পড়াশোনা করতে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর অভিজিতের তৎপরতা (অ্যাক্টিভিজম) শুরু হয়। তিনি এখানে ইয়াহু ইমেইল গ্রুপ ও পরে ব্লগ মডারেট করা শুরু করেন।
রশিদ বলেন, 'গ্রুপটি নেতৃস্থানীয় ও বেশ জনপ্রিয় ছিল, ফেসবুক ও টুইটারের বহু আগে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় তিনি (অভিজিৎ) ছিলেন ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমান, মার্জিত ও পরিপক্ব। তাঁর লক্ষ্য ছিল তাঁদের মন জয় করা।'
২০০২ সালে সিঙ্গাপুরে থাকার সময় অভিজিৎ একটি ব্লগে লেখা (পোস্ট) লক্ষ করেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এক নারী লেখেন, 'আমি বুঝতে পারি না মানুষ কেন রূপকথা বিশ্বাস করে। তিনিই ছিলেন রাফিদা আহমেদ বন্যা, পরে অভিজিতের সহধর্মীণী হন। বন্যা স্মরণ করেন, 'সেই পোস্টের জন্য অনেক লোক আমাকে আক্রমণ করে। সে সময় আমি আটলান্টায় টেক ম্যানেজার ছিলাম, আমার মেয়েকে নিয়ে থাকতাম। আমি ভয় পেলাম, কোনো জবাব দিলাম না। পরের দিন অভিজিৎ রায় নামের একজন আমার পক্ষে কথা বললেন।'
কয়েক বছর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা দেখা করেছিলেন এবং অভিজিৎ ২০০৬ সালে সিঙ্গাপুর থেকে আটলান্টায় চলে এলেন : মেয়ের হাইস্কুল শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাফিদা যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যেতেন না। বায়োমেডিক্যাল গবেষণায় অভিজিৎ ডক্টরেট ডিগ্রি নিলেন এবং আকর্ষণীয় চাকরি পেয়ে গেলেন। সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও পেয়ে গেলেন।
মেয়ে ত্রিশা আহমেদ কলেজে ভর্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক দম্পতি ঢাকায় বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তাঁরা রওনা হন।
রাফিদা বলেন, 'আমরা জানতাম, এ ধরনের দেশে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলাম। তাঁর বিরুদ্ধে কেবল একবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তবে আমরা এতে গুরুত্ব দেইনি। অন্যথায় আমরা যেতাম না।'
বইমেলায় অভিজিৎ একজন তারকা। মৃত্যুর আগে কোনো শান্ত সকালে বন্যার সঙ্গে যৌথভাবে তিনি একটি বই লেখার পরিকল্পনা করেন এবং তাঁকে রিকশায় তাঁর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরতে বেরিয়ে ছিলেন। মেয়ের সঙ্গে ফেসবুকে কথা বলেন। মেয়েও তাঁকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর কলেজে নারীবাদী গ্লোরিয়া স্টাইনেমের বক্তব্য তাঁর ভালো লেগেছে।
রাফিদা বলেন, 'আমরা সত্যি, সত্যি খুব সুখী ছিলাম।' স্বামীর প্রভাব তিনি বাংলাদেশে আগে কখনো দেখেননি। তিনি বলেন, 'শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে দেখালেন, কীভাবে ও কেন তাঁর কাজ গুরুত্বপূর্ণ।'
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিপক্ষে সহিংস হামলা চলছে। সর্বশেষ ৩০ মার্চ অভিজিতের সমর্থক ওয়াশিকুর রহমানকে ঢাকায় কুপিয়ে হত্যা করে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা।
অভিজিৎকে হত্যার দায়ে ঢাকার একজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, অভিজিৎ ও ওয়াশিকুরকে জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারউল্লাহ বাংলা টিম হত্যা করেছে।
রাফিদা বলেন, 'আমরা যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও এটা ভয়ঙ্কর।'
রয়টার্স থেকে অনূদিত