কানাডায় রেকর্ডসংখ্যক ভিসা প্রত্যাখ্যান, কেন বাড়ছে এই সংখ্যা?

দীর্ঘদিন ধরেই কানাডাকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, কর্মী ও পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু দেশটি বর্তমানে তাদের অভিবাসন নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে।
২০২৪ সালে কানাডা ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ১৫৭টি অস্থায়ী বাসিন্দা (টেম্পোরারি রেসিডেন্ট) ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে, যা মোট আবেদনের ৫০ শতাংশ। এটি ছিল দেশটির রেকর্ডসংখ্যক প্রত্যাখ্যান। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৩৫ শতাংশ। খবর ইমিগ্রেশন নিউজ কানাডার।
এই ব্যাপক পরিবর্তন কঠোর ভিসা নিয়মের কারণে ঘটেছে, যা বিশ্বব্যাপী আবেদনকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। স্টাডি পারমিট, ওয়ার্ক পারমিট ও ভিজিটর ভিসার ওপর নজিরবিহীন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডার (আইআরসিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ২৩ লাখ ৬০ হাজার অস্থায়ী বাসিন্দার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যা করোনা মহামারির আগের সময় ২০১৯ সালের পর সর্বোচ্চ হার।
২০২৩ সালে ১৮ লাখ ৫০ হাজার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, যা ছিল ৩৫ শতাংশ। এবার ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে।
প্রধান ভিসা ক্যাটাগরিতে প্রত্যাখ্যানের পরিসংখ্যান :
ভিজিটর ভিসা : ১৯ লাখ ৫০ হাজার আবেদন (৫৪ শতাংশ) বাতিল, যা ২০২৩ সালের ৪০ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ বেশি।
স্টাডি পারমিট : দুই লাখ ৯০ হাজার ৩১৭ আবেদন (৫২ শতাংশ) প্রত্যাখ্যাত, যা ২০২৩ সালের ৩৮ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি।
ওয়ার্ক পারমিট : এক লাখ ১৫ হাজার ৫৪৯ আবেদন (২২ শতাংশ) বাতিল, যা ২০২৩ সালের ২৩ শতাংশ থেকে সামান্য কম।
এই উচ্চ প্রত্যাখ্যান হার সরাসরি কানাডার নতুন কৌশলের অংশ, যার লক্ষ্য ২০২৬ সালের মধ্যে অস্থায়ী বাসিন্দাদের সংখ্যা ৬.৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা।
কেন ভিসা প্রত্যাখ্যান বাড়ছে?
১. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও সম্পদের ওপর চাপ
কানাডার জনসংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রধান কারণ মহামারির পর অস্থায়ী অভিবাসীদের প্রবাহ।
২০২৩ সালের মধ্যে অস্থায়ী বাসিন্দারা মোট জনসংখ্যার ৬.৫ শতাংশ দখল করেছিল, যা আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও সরকারি পরিষেবার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছিল।
ফলে ২০২৪ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ২০২৬ সালের মধ্যে এই হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।
এই কড়াকড়ির ফলে বিশেষ করে ভিজিটর ভিসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫৪ শতাংশ প্রত্যাখ্যান দেখা গেছে, যেখানে কর্মকর্তারা আবেদনকারীদের কানাডা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছার ওপর কঠোর নজর রাখছেন।

২. আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নীতি পরিবর্তন
কানাডার স্টাডি পারমিটের জন্য কঠোর নতুন নিয়ম চালু হয়েছে, যার ফলে ৫২ শতাংশ স্টাডি ভিসা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
স্টাডি পারমিটের সীমা : ২০২৪ সালে নতুন আবেদনকারীদের সংখ্যা সীমিত করে তিন লাখ ৬০ হাজার করা হয়েছে।
স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : কেবলমাত্র উন্নতমানের ডিজাইনেটেড লার্নিং ইনস্টিটিউশন (ডিএলআই)-এ ভর্তিতে শিক্ষার্থীরা অগ্রাধিকার পাবে।
প্রতারণা দমন : নতুন লেটার অব অ্যাকসেপ্টেন্স (এলওএ) যাচাই প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত নয় হাজার ভুয়া আবেদন চিহ্নিত করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক যোগ্যতা : নতুন নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনকারীদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে, যা অনেক শিক্ষার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
৩. ভিজিটর ভিসার কঠোর যাচাই
২০২৪ সালে ভিজিটর ভিসার ৫৪ শতাংশ আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
সাধারণ প্রত্যাখ্যান কারণগুলো হলো :
* আবেদনকারীর নিজ দেশে স্থায়ী সম্পর্কের অভাব (যেমন, পরিবার, চাকরি)।
* ভ্রমণের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট।
* কানাডায় অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা।
৪. ওয়ার্ক পারমিট তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল
ওয়ার্ক পারমিট প্রত্যাখ্যানের হার সামান্য হ্রাস পেয়েছে—২৩ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশ হয়েছে।
কানাডা এখনো স্বাস্থ্যসেবা ও নির্মাণ খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের জন্য দক্ষ কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল।
নভেম্বর ২০২৪-এ কঠোর শ্রম বাজারের প্রভাব মূল্যায়ন (এলএমআইএ) নীতি চালু হয়েছে, যা কম দক্ষ কর্মীদের ভিসা পাওয়া কঠিন করে তুলেছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব : সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
ইতিবাচক দিক :
আবাসন খাতে চাপ কমবে : ২০২৩ সালে কানাডায় ভাড়ার হার ১.৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন। কম অভিবাসী মানে আবাসন চাহিদা কমবে।
স্বাস্থ্যসেবার চাপ কমবে : হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর দীর্ঘ অপেক্ষার সময় কিছুটা কমতে পারে।
নেতিবাচক দিক :
কানাডার বৈশ্বিক খ্যাতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে : আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা কানাডার অর্থনীতিতে ২২ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার অবদান রাখে এবং দুই লাখ ১৮ হাজার চাকরি সৃষ্টি করে।
পর্যটন খাতে ধাক্কা : ২০২৪ সালে কঠোর ভিসা নীতির কারণে পর্যটন শিল্প সংকটে পড়তে পারে।
একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আইসিইএফ মনিটরকে বলেছেন, ‘কানাডা এখন বিশ্বের কাছে সংকেত পাঠাচ্ছে যে তারা ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত নয়।’
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কী?
২০২৫ সালে কানাডার অভিবাসন নীতির ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত।
২০২৪ সালের আইআরসিসি ২০২৫-২০২৭ অভিবাসন পরিকল্পনা ইঙ্গিত দেয় যে অস্থায়ী বাসিন্দাদের সংখ্যা আরও কমতে পারে। তবে, শ্রম ঘাটতি ও বৃদ্ধ জনসংখ্যার কারণে নীতিতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
বর্তমানে, ভিসা আবেদনকারীদের জন্য পথ আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।