যেভাবে পাকিস্তানে আঘাত হানতে পারে ভারত

জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। এ ঘটনার সঙ্গে ইসলামাবাদ জড়িত বলে অভিযোগ করে নয়াদিল্লি। তবে ইসলামাবাদ তা নাকচ করে দিয়ে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় এই হামলার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, ‘পাকিস্তানের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, ভারত পেহেলগাম ঘটনায় জড়িত থাকার ‘ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অভিযোগের’ অজুহাতে আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে।’
এর কয়েক ঘণ্টা আগেই ভরতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটির সামরিক বাহিনীকে গত সপ্তাহে দখলকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের হামলার জবাব দেওয়ার জন্য ‘পূর্ণ অপারেশনাল স্বাধীনতা’ দিয়েছেন। তিনি মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) ও বুধবার (৩০ এপ্রিল) একাধিক নিরাপত্তা বৈঠক করেছেন। যা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে আসন্ন ভারতীয় সামরিক অভিযানের জল্পনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ ঘটনায় পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত দক্ষিণ এশীয় দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় অস্তিত্বহীন সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। দেশগুলো যেমন কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা কমিয়েছে, তেমনি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে তাদের অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে।
পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়া কতটা আসন্ন এবং এটি কেমন হতে পারে? এ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা।
ভারত কী সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে?
ভারত কী পদক্ষেপ নেবে তা অস্পষ্ট হলেও, অতীতে দেশটি বিভিন্ন সামরিক কৌশল ব্যবহার করেছে। তাদের কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো—
গোপন সামরিক অভিযান
কয়েক দশক ধরে ভারত ও পাকিস্তান প্রত্যেকেই একে অপরের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে একাধিক গোপন অভিযান চালিয়েছে, সামরিক পোস্টে হামলা চালিয়েছে, সৈন্যদের হত্যা করেছে। এই হামলাগুলো প্রায়শই প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে সামরিক ইউনিট দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
তবে এই ধরনের অভিযান কখন চালানো হবে তা কখনই নিশ্চিত করা হয় না। নিয়ম হলো অন্য দেশকে একটি বার্তা দেওয়া। কিন্তু তাকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য না করা, যার ফলে উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি কমানো যায়।
‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’
কখনো কখনো অভিযানের বিষয়ে সূক্ষ্ম বার্তা পাঠানো হয়। কোনো একটি হামলা জনসমক্ষে এনে অন্য দেশকে বিব্রত করা, চাপে রাখা। এটি রাজনৈতিকভাবেও সহায়ক।
ভারত অতীতে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে নির্দিষ্ট, নির্বাচিত লক্ষ্যবস্তুতে তথাকথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছে—সবচেয়ে সম্প্রতি ২০১৬ সালে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে।
তখন সশস্ত্র যোদ্ধারা ভারত শাসিত কাশ্মীরের উরিতে ১৭ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে। নয়াদিল্লি তখন অভিযোগ করেছিল, সন্ত্রাসীরা আবারও ভারতে হামলার পরিকল্পনা করছিল। এ ঘটনায় ভারতীয় সেনাদের বিশেষ বাহিনী প্রকৃত সীমান্ত পেরিয়ে ‘লঞ্চ প্যাড’-এ হামলা চালায়।
তখন ভারত দাবি করেছিল যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে তাদের কয়েক ডজন যোদ্ধা নিহত হয়েছে। যদিও স্বাধীন বিশ্লেষকরা মনে করেন মৃতের সংখ্যা সম্ভবত অনেক কম ছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল রণবীর সিং বলেন, ‘অভিযানগুলো মূলত এই সন্ত্রাসীরা যাতে অনুপ্রবেশ এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে দেশের নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করতে না পারে, কিংবা সফল না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য চালানো হয়।’

বিমান হামলা
ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ৪০ জন ভারতীয় আধা-সামরিক সৈন্য নিহত হয়। ওই হামলার দায় স্বীকার করে পাকিস্তান-ভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ।
এ ঘটনায় ব্যাপক ক্ষোভের মধ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে বিমান হামলা চালায়। ভারত দাবি করে যে, তারা সন্ত্রাসীদের আস্তানাগুলোতে আঘাত হানে এবং কয়েক ডজন যোদ্ধাকে হত্যা করে।
প্রতিউত্তোরে পাকিস্তান জোর দিয়ে বলেছিল, ভারতীয় বিমান কেবল একটি বনভূমি অঞ্চলে আঘাত হেনেছে এবং কোনো যোদ্ধাকে হত্যা করেনি। ইসলামাবাদ দাবি করে যে, তারা বিমান মোতায়েন করে ভারতীয় বিমানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ফেরত পাঠায়।
তবে এর একদিন পর ভারতীয় ও পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান আবারও আকাশযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তান তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের অভ্যন্তরে একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে। একজন ভারতীয় ফাইটার পাইলটকে বন্দী করে এবং কয়েক দিন পর তাকে ফেরত পাঠানো হয়।
পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত ভূমি দখলের চেষ্টা
গত কয়েক বছরে ধরে ভারতে ক্রমবর্ধমানভাবে দাবি উঠেছে—নয়াদিল্লির পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করা উচিত। পেহেলগাম হামলার পর সেই দাবি আরও তীব্র হয়েছে। এমনকি বিরোধী কংগ্রেস পার্টির নেতারাও মোদি সরকারকে সেই অঞ্চল ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
যদিও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করা প্রতিটি ভারতীয় সরকারের নীতিগত উদ্দেশ্য। উভয় পক্ষের প্রায় সমান সামরিক সক্ষমতার কারণে এটিকে অসম্ভাব্য প্রচেষ্টা হিসেবে মনে করা হয়। তবে পাকিস্তানের কাছ থেকে বিতর্কিত অঞ্চল সফলভাবে দখলের অতীত রেকর্ড ভারতের রয়েছে।
১৯৮৪ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী অপারেশন মেঘদূত শুরু করে। যার মাধ্যমে তারা দ্রুত হিমালয়ের সিয়াচেন হিমবাহ দখল করে নেয়। যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথে প্রবেশে বাধা দেয়। বিশ্বের বৃহত্তম অমেরু হিমবাহগুলোর মধ্যে অন্যতম সিয়াচেন তখন থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র। যেখানে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সামরিক ফাঁড়ি একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
নৌ-অভিযান
পহেলগাম হামলার পর ভারতীয় নৌবাহিনী ঘোষণা করে যে, তারা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে।
নৌবাহিনী ২৭ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলো প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম এবং ক্রুদের দীর্ঘ পাল্লার নির্ভুল আক্রমণাত্মক হামলার জন্য প্রস্তুতি পুনরায় যাচাই ও প্রদর্শনের জন্য সফলভাবে একাধিক জাহাজবিধ্বংসী ফায়ারিং চালিয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে, যে কোনো উপায়ে দেশের সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষায় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।’
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই পরীক্ষাগুলো শক্তির প্রদর্শন ছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রয়োজন হলে পাকিস্তানি ভূখণ্ডে আঘাত হানার ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘাত
ভারত ও পাকিস্তান তাদের স্বাধীন অস্তিত্বের ৭৮ বছরে চারবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই সশস্ত্র সংঘাতের তিনটিই কাশ্মীর নিয়ে হয়েছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ১৯৪৭ সালের আগস্টে উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করে চলে যাওয়ার দুই মাস পর, প্রতিবেশী দেশগুলো কাশ্মীর নিয়ে তাদের প্রথম যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যা তখন একজন রাজা দ্বারা শাসিত ছিল।
পাকিস্তানি মিলিশিয়ারা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করার জন্য কাশ্মীর আক্রমণ করে। রাজা হরি সিং ভারতের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। নয়াদিল্লি রাজি হয় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। তবে শর্ত ছিল যে, সিং একটি অন্তর্ভুক্তির দলিল স্বাক্ষর করবেন, যার মাধ্যমে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে একীভূত হবে। রাজা রাজি হন।
অবশেষে ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তখন থেকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীরের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসে।
১৯৬৫ সালে তাদের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়। যখন ভারতীয় বাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের লাহোরে প্রবেশ করে এবং হামলা চালায় তখন পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবিরতি রেখা পেরিয়ে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে প্রবেশ করে। উভয় পক্ষের হাজার হাজার হতাহতের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাব প্রতিবেশীদের যুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ও ভারত পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। যেখানে ভারতীয় বাহিনী অঞ্চলটিকে স্বাধীন করতে সাহায্য করে। যার ফলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর ১৯৭২ সালে দুটি দেশ সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে একটি নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে এবং কার্গিল যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। ভারতীয় সৈন্যরা লাদাখ অঞ্চলের বরফাবৃত উচ্চতায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সৈন্যদের পিছু হটতে বাধ্য করে।
বিশ্ব নেতাদের সমঝোতার চেষ্টা
এদিকে, ভারত ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরকে বিভক্তকারী নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর গোলাগুলি বিনিময় অব্যাহত রাখায় বিশ্ব নেতারা উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক রুবিওর উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা উভয় পক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ করছি, এবং... পরিস্থিতি বাড়াতে না বলার জন্য তাদের বলছি’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
এ ছাড়াও মঙ্গলবার, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেন, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ‘উত্তেজনা কমাতে’ তার সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছেন।
পেহেলগাম হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট চরম উত্তেজনা আঞ্চলিক শান্তির জন্য বড় হুমকি। যদিও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের ঝুঁকি এখনো কম, তবে যেকোনো ভুল পদক্ষেপ বা সামান্য উসকানিও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। বিশ্বনেতাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে শান্তির একমাত্র আশা দেখাচ্ছে। উত্তেজনা প্রশমন ও আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করাই এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। অন্যথায়, পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের সংঘাত পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।